Last Updated on 7th April 2024 by Mijanur Rahman
বিশ্বব্যাপী অনেক মানুষ ভিটামিন ডি এর অভাবে ভুগছেন। ভিটামিন ডি এর অভাব যে কোনো বয়সের মানুষের হতে পারে। তবে দক্ষিণ এশিয়ার মানুষের মধ্যে ভিটামিন ডি এর অভাব তুলনামূলক বেশি। ভিটামিন ডি এর অভাব সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করতে ২ নভেম্বর ভিটামিন ডি দিবস হিসেবে উদযাপিত হয়।
তো যাই হোক এই লেখাতে আমরা বিস্তারিতভাবে জানবো ভিটামিন ডি এর উপকারিতা, ভিটামিন ডি কি? ভিটামিন ডি জাতীয় খাবার কি কি ইত্যাদি সম্পর্কে বিস্তারিত।
ভিটামিন ডি কি?
ভিটামিন ডি এক প্রকার ভিটামিন যা ফ্যাট দ্রবনীয়। এটি একটি সেকোস্টেরয়েড গ্রুপ যা অন্ত্রে ক্যালসিয়াম (Ca), ম্যাগনেসিয়াম (Mg) ও ফসফেট (P) এর আন্ত্রিক শোষণ এবং ক্যালসিয়াম হোমিওস্টাসিস নিয়ন্ত্রণে কাজ করে।
ভিটামিন ডি৩ (কলিক্যালসিফেরল) এবং ভিটামিন ডি২ (আর্গোক্যালসিফেরল) হলো মানবদেহে সেকোস্টেরয়েড গ্রুপের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যৌগ। ভিটামিন ডি হাড় গঠনের জন্য অপরিহার্য এবং এটি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়।
প্রকারভেদ (Types)
- ভিটামিন D1 : আর্গোক্যালসিফেরলের সাথে লুমিস্টেরলের ১ঃ১ অনুপাতে রাসায়নিক মিশ্রণে
- ভিটামিন D2 : আর্গোক্যালসিফেরল (আর্গোস্টেরল থেকে তৈরি)
- ভিটামিন D3 : কোলেক্যালসিফেরল
(৭- ডিহাইড্রোকোলেস্টেরল থেকে ত্বকে তৈরি হয়)।
- ভিটামিন D4 : ২২ – ডাইহাইড্রোআর্গোক্যালসিফেরল
- ভিটামিন D5 : সিটোক্যালসিফেরল (৭-ডিহাইড্রোসিটোস্টেরল থেকে তৈরী)
ভিটামিন ডি এর বেশ কয়েকটি ফর্ম রয়েছে-
- ভিটামিন ডি2 বা আর্গোক্যালসিফেরল
- ভিটামিন ডি3 বা কোলেক্যালসিফেরল
এই দুটিকে সম্মিলিতভাবে ক্যালসিফেরল বলে।
ভিটামিন ডি ও ডি ৩ পার্থক্য
ভিটামিন ডি এবং ভিটামিন ডি ৩ এর মধ্যে প্রধান পার্থক্য হলো উৎস। ভিটামিন ডি সাধারণত সূর্যের আলো থেকে উৎপন্ন হয় এবং কম ব্যয়বহুল খাবারেও পাওয়া যায়। কিন্থ ভিটামিন ডি ৩ প্রানীজ খাবার থেকে বেশি পাওয়া যায়। ভিটামিন ডি ৩ অস্টিওপরোসিস, অস্টিওমেলাশিয়া,রিকেটস থেকে রক্ষ করে।
ভিটামিন ডি এর উৎস
আমরা ভিটামিন ডি কি এতোক্ষণ জানলাম, এবার চলুন জেনে নেই ভিটামিন ডি সহজে কোথায় থেকে পাবোঃ
সূর্যের আলো
ভিটামিন ডি এর প্রধান প্রাকৃতিক উৎস হলো সূর্যের আলো।সূর্যের আলোর উপস্থিতিতে রাসায়নিক বিক্রিয়ার মাধ্যমে ত্বকের এপিডার্মিসের নীচের স্থানে কলিক্যালসিফেরলের সংশ্লেষণের মাধ্যমে ভিটামিন ডি তৈরি হয়।
সূর্যের অতিবেগুনী আলোতে জন্মানো মাশরুম
শুকনো মাশরুম খেতে পারেন,মাশরুমে প্রচুর পরিমানে ভিটামিন ডি রয়েছে। মাশরুমে রয়েছে ভিটামিন ডি ২৷ সূর্যের আলোতে জন্মানো মাশরুমে প্রচুর পরিমানে ভিটামিন ডি রয়েছে। অনেক ভাবেই মাশরুম খাওয়া যায়। পাস্তা, সালাদসহ অন্যান্য খাবারের সাথে মাশরুম খাওয়া যায়।।
দুধ
দুধ একটি সুষম খাদ্য। এতে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন ডি ও রয়েছে। প্রতিদিন নিয়ম করে পরিমিত দুধ গ্রহণ করতে পারেন। গরমকালে দুধের সাথে অল্প হলুদ মিশিয়ে খেলে তা রোগ প্রতিরোধে সাহায্য করে। দুধ দৈনিক চাহিদার ১৫-২২% ভিটামিন ডি এর চাহিদা মেটায়।
ডিম
(বিশেষত ডিমের কুসুম) – ডিমের সাদা অংশে প্রোটিন এবং কুসুমে ফ্যাট ও মিনারেলস পাওয়া যায়।
সামুদ্রিক মাছ
যেমন – স্যামন, সাডিন, টুনা,ম্যাকেরেল, হ্যারিং, ইলিশ মাছের ডিম, চিংড়ি ইত্যাদি।
দই
দই অনেক স্বাস্থ্যকর এবং এটি হজমে সাহায্য করে। এটি শরীরের হাড় মজবুত করতে সাহায্য করে এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়।
ওটমিল
ওটমিলের সাথে দুধ মিশিয়ে খেলে তা অনেক স্বাস্থ্যকর খাবার হয়। এটি ডায়বেটিস ও নিয়ন্ত্রণ করে।
- চর্বিযুক্ত মাছ এবং মাংস, লাল মাংস ( Red meat)
- কড মাছের যকৃতের তেল
- কলিজা,গরুর যকৃত
- মাখন,পনির, ছানা
- বিভিন্ন রকমের ডাল।
- মটরশুটি, সীমের বিচি
- ভোজ্য তেল
ফরটিফায়েড (Fortified) খাবার
কিছু কিছু খাবারে ফরটিফায়েড করে ভিটামিন ‘ডি’ বাড়ানো যায়। এসব ফরটিফায়েড খাবার বিশ্বের অন্যান্য দেশে বেশি দেখা যায় কিন্তু আমাদের দেশে তেমন একটা প্রচলিত না।যেমন-কিছু সিরিয়ালস(Cereals), ওটস (Oats), ফরটিফায়েড কমলার জুস।
সাপ্লিমেন্টারি
উচ্চমাত্রার ভিটামিন ‘ডি’-সমৃদ্ধ খাবার সবসময় পাওয়া যায় না বলে সাধারণ মানুষের মধ্যে ভিটামিন ডি এর ঘাটতি রয়ে যায়। তখন ভিটামিন ‘ডি’ সাপ্লিমেন্টারির প্রয়োজন পড়ে।তবে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী সাপ্লিমেন্টারি গ্রহণ করা উচিত।
প্রয়োজনীয় মাত্রা
মার্কিন ইনস্টিটিউট অফ মেডিসিনের মতে,আমাদের দৈনিক ১০-২০ মাইক্রোগ্রাম ভিটামিন ডি খাওয়া প্রয়োজন।
বয়য়া ভেদে এই মাত্রা কম বেশি হয়ে থাকে।যেমন – এক বছর বয়য়া পর্যন্ত ৬০০ ইউনিট। ০১ থেকে ৭০ বছর পর্যন্ত ৬০০ থেকে ৭০০ ইউনিট। আর ৭০ এর উপরে ৭০০ ইউনিটের বেশি।
ভিটামিন ডি এর উপকারিতা
- শরীরের হাড় গঠনে সহায়তা করে।
- হাড় মজবুত করে।
- শরীরে ক্যালসিয়াম শোষণ বাড়ায়।
- কয়েক ধরনের ক্যানসার প্রতিরোধ করে।
- হৃদরোগ প্রতিরোধ করে।
- স্ট্রোক ঠেকাতে সাহায্য করে।
- জন্মগত ত্রুটির হার কমায়।
- অটোইমিউন রোগ থেকে রক্ষা করে।
- দাঁতের গঠন করে।
- শরীরের কোষে কোষে আন্ত যোগাযোগ ও কোষের বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণে কাজ করে।
- অপারেশন বা শল্যচিকিৎসায় কাটা স্থানের প্রদাহ কমাতে কাজ করে।
- মস্তিষ্কে অ্যাড্রেনালিন (Adrenaline), নরঅ্যাড্রেনালিন (Noradrenaline), ডোপামিন (Dopamine) নামক হরমোন নিঃসরণে প্রভাবিত করে।
- সেরোটোনিন (Serotonin) ও ডোপামিন ক্ষয়ে যাওয়া রোধে কাজ করে।
- মেজাজ ঠিক রাখতে সাহায্য করে।
- মস্তিষ্ককে ক্ষতিকর রাসায়নিকের প্রভাব থেকে রক্ষায় করে।
- ব্যথা কমাতে কার্যকরী ভূমিকা পালক করে।
- ইনসুলিনের মাত্রা ঠিক রাখতে সাহায্য করে যা ডায়বেটিস রোগীর জন্য খুবই উপকারী।
- ভিটামিন ডি ক্যালসিয়াম এবং ফসফেটের শোষণ নিয়ন্ত্রণ করে,যা শিশুদের স্বাভাবিক বৃদ্ধি এবং বিকাশে অবদান রাখে।
- ভিটামিন ডি ক্যাথেলিসিডিন নামক পদার্থের উৎপাদন বাড়িয়ে দেয় যা ভাইরাস এবং ব্যাকটেরিয়ার সাথে লড়াই করে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়।
- ভিটামিন ডি রক্তে শর্করার মাত্রা বাড়ায়।
- ভিটামিন ডি গর্ভাবস্থায় সাহায্য করে।
- চোখের দৃষ্টি ভালো রাখে।
- শরীরের খারাপ কোলেস্টেরোল কমাতে সাহায্যে করে
- হার্ট এর সমস্যা কমায়
- দীর্ঘদিনের মাথা ব্যথা সারায়।
কোন খাবারে কি পরিমান ভিটামিন ডি রয়েছে
স্যামন মাছ
৫২৬ IU ( স্যামন মাছ প্রতিদিনের ৬৬% ভিটামিন ডি এর চাহিদা মেটায়)
ডিমের কুসুম
৩৭ IU ( প্রতিদিনের চাহিদার ৫% চাহিদা মেটায়)
কমলার জুস
১০০ IU ( প্রতিদিনের ১২% চাহিদা মেটায়)
ভিটামিন ডি এর অভাবে যেসব রোগ হয়
শরীরে ভিটামিন ডি এর ঘাটতি হলে মানবদেহে সরাসরি কিছু কিছু রোগ বালাই দেখা দিতে পারে, সেগুলো হলোঃ
রিকেটস (Rickets)
শিশুদের হাড় নরম হয়ে যায়, ভেংগে যায়, মাথার খুলি বড় হয়ে যায়।
অস্টিওপরোসিস (Osteoporosis)
ক্যালসিয়ামের অভাবে এই রোগ হয়। হাড়ের সঠিক বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজন ভিটামিন ও ক্যালসিয়াম সমৃদ্ধ খাবার।বয়স্ক পুরুষ ও মহিলাদের সাধারণত এ রোগটা হয়ে থাকে ভিটামিন ডি এর অভাবে। যেসব বয়স্ক পুরুষ অনেকদিন ধরে স্টেরয়েড ঔষুধ সেবন করে আসছে তাদের এবং মহিলাদের মেনোপস (Menopause) হবার পর এই রোগ হবার সম্ভাবনা বেশি থাকে।
অস্টিওম্যালাসিয়া (Osteomalacia)
অস্টিওম্যালাসিয়ায় শরীরের হাড় নরম হয়ে যায়। এই রোগের মূল কারণ হলো ভিটামিন-ডি এর স্বল্পতা। ভিটামিন-ডি এর অভাবে শরীরের হাড় ঠিকমতো গঠিত হয় না। ভিটামিন ডি এর অভাবে হাড়ে ক্যালসিয়াম ও ফসফরাসের পরিমান কমে যায় ফলে হাড় নরম হয়।
অটোইমিউন ডিজিজ (Autoimmune disease)
অটোইমিউন রোগ হচ্ছে এক প্রকার শারীরিক অবস্থা যা শরীরের একটি স্বাভাবিক অংশে অস্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে।
- সিলিয়াক রোগ
- প্যানক্রিয়াটাইটিস ( Pancreatitis)
- কার্ডিওভাসকুলার ডিজিজ (Cardiovascular disease)
- গাঁটে ব্যথা
- বৃদ্ধদের বাতের সমস্যা
- থাইরয়েডে সমস্যা
- মেরুদণ্ডের ব্যথা
- অসময়ে দাঁত পড়ে যাওয়া
- শরীরে ম্যাজম্যাজে ভাব
- হাত-পায়ে ব্যথা
- পরিমিত খাওয়ার পর ও ওজন কমতে থাকা
কিভাবে বুঝবেন শরীরে ভিটামিন ডি এর অভাব?
শরীরে ভিটামিন ডি এর ঘাটতি আছে কিনা তা জানার জন্য কিছু টেস্ট করা হয়। এছাড়াও কিছু কিছু উপসর্গ দেখে বুঝা যায় শরীরে ভিটামিন ডি এর ঘাটতি রয়েছে কিনা। যেমন-
- ঘন ঘন অসুস্থ হয়ে পড়া।
- অকারণে পরিশ্রম ছাড়াই ক্লান্তি বোধ করা।
- বিষন্নতা, হতাশা
- অতিরিক্ত চুল পড়া।
- ঘা দেরিতে শুকায়।
- পাচনে সমস্যা
- দূর্বলতা
- গিটে ব্যথা
- খুব বেশি মাথা ঘামানো
- হাড়ে ব্যথা
- দাঁতে ব্যথা
ডিমের অপকারিতা
ভিটামিন ডি বেশি গ্রহন করলে তেমন কোনো সমস্যা হয় না। তবে মাত্রারিক্ত গ্রহণ করলে কিছু সমস্যা দেখা দিতে পারে –
- হজমে সমস্যা
- মাথা ঘুরা
- বমি
- ক্ষুধা কমে যাওয়া
- ক্লান্তি ভাব
- কিডনিতে কিছু সমস্যা
ভিটামিন ডি আমাদের শরীরে অনেক গুরুত্বপূর্ণ একটি ভুমিকা পালন করে। শরিরের হাড়, দাত গঠন, রোগ প্রতিরোধসহ আরো নানা কাজে সহায়তা করে। পরিমিত ও নিয়মিত খাদ্য ও অভ্যাসের মাধ্যমে ভিটামিন ডি গ্রহন করা উচিত। ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া সাপ্লিমেন্ট গ্রহন থেকে বিরত থাকবেন।