Last Updated on 7th April 2024 by Mijanur Rahman
কৃষিপ্রধান এই বাংলার মাটিতে সারের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। বাংলাদেশে বেশকিছু উন্নতমানের সার কারখানা বিভিন্ন জেলায় স্থাপিত রয়েছে। সেখান থেকে উৎপাদিত সার দেশের কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি ও জাতীয় অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। সার কারখানাগুলো নিরবচ্ছিন্ন উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করছে। ফলে বাংলাদেশ আজ খাদ্য স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করছে।
বাংলাদেশের মোট সার কারখানা
বাংলাদেশে মোট ১৫ টি সার কারখানা রয়েছে যার মধ্যে ৮টি সার কারখানা সরকারি। সে আটটি কারখানা হলো-
১. চিটাগাং ইউরিয়া ফার্টিলাইজার ফ্যাক্টরী লিমিটেড।
চিটাগাং ইউরিয়া ফার্টিলাইজার লিঃ কারখানাটি চিটাগাং শহর থেকে ২৪ কিলোমিটার দক্ষিণে এবং কর্ণফূলী নদীর দক্ষিণ তীরে ১৯৮৭ সালে রাঙ্গাদিয়া, থানা- আনোয়ারা, চট্টগ্রাম জেলায় স্থাপিত হয়। এ ফ্যাক্টরীর বার্ষিক উৎপাদন ক্ষমতা ৫,৬১,০০০ মেট্রিক টন।
২. যমুনা ফার্টিলাইজার কোম্পানী লিমিটেড।
এ কারখানাটি যমুনা নদী হতে প্রায় ১০ কিলোমিটার দূরত্বে ১৯৯২ সালে তারাকান্দি, থানা- সরিষাবাড়ী, জামালপুর জেলায় স্থাপিত হয়। এ ফ্যাক্টরীর বার্ষিক উৎপাদন ক্ষমতা ৫,৬১,০০০ মেট্রিক টন।
৩. আশুগঞ্জ ফার্টিলাইজার এ্যান্ড কেমিক্যাল কোম্পানী লিমিটেড।
আশুগঞ্জ ফার্টিরাইজার এন্ড কেমিক্যাল কোম্পানী লিঃ ঢাকা শহর হতে ১১০ কিলোমিটার উত্তর-পূর্ব দিকে এবং আশুগঞ্জ রেলষ্টেশন থেকে ৪ কিলোমিটার দক্ষিণে, ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের পাশে আশুগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলায় ১৯৮১ সালে কারখানাটি স্থাপিত হয়। এ ফ্যাক্টরীর বার্ষিক উত্পাদন ক্ষমতা ৫,২৮,০০০ মেট্রিক টন।
৪. শাহজালাল ফার্টিলাইজার কোম্পানী লিমিটেড।
এ কারখানা সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জে অবস্থিত।
৫. ইউরিয়া ফার্টিলাইজার ফ্যাক্টরী লিমিটেড।
ইউরিয়া ফার্টিলাইজার ফ্যাক্টরী লিমিটেড দেশের দ্বিতীয় ইউরিয়া সার কারখানা যা শীতলক্ষা নদীর তীরে ১৯৭০ সালে পলাশ, ঘোড়াশাল, নরসিংদী জেলায় স্থাপিত হয়। এ ফ্যাক্টরীর বার্ষিক উত্পাদন ক্ষমতা ৪,৭০,০০০ মেট্রিক টন।
৬. পলাশ ইউরিয়া ফার্টিলাইজার ফ্যাক্টরী।
পলাশ ইউরিয়া ফার্টিলাইজার ফ্যাক্টরী লিঃ কারখানাটি বন্ধুত্বের চিহ্ন স্বরূপ চায়না-বাংলাদেশের একটি যৌথ উদ্যোগ যা ১৯৮৫ সালে শীতলক্ষ্যা নদীর তীরে পলাশ, নরসিংদী জেলায় স্থাপিত হয়। এ ফ্যাক্টরীর বার্ষিক উত্পাদন ক্ষমতা ৯৫,০০০ মেট্রিক টন।
৭. টিএসপি কমপ্লেক্স লিমিটিড।
টিএসপি কমপ্লেক্স লিঃ, উত্তর পতেঙ্গা, চট্টগ্রাম দেশের একমাত্র ফসফেটিক সার কারখানা। টিএসপি কমপেস্নক্স লিঃ এর স্থাপনা তৎদকালীন পূর্ব-পাকিস্তান শিল্প উন্নয়ন সংস্থা (ইপিআইডিসি’র) সময়ে আরম্ভ হলেও ১৯৭৬ সালে বাণিজ্যিক উৎপাদনে যায়। এ ফ্যাক্টরীর বার্ষিক উত্পাদন ক্ষমতা ১,০০,০০০ মেট্রিক টন।
৮. ডিএপি ফার্টিলাইজার কোম্পানী লিমিটেড।
এটি চিটাগাং শহর থেকে ২৪ কিলোমিটার দক্ষিণে এবং কর্ণফূলী নদীর দক্ষিণ তীরে ২০০৬ সালে রাঙ্গাদিয়া, থানা- আনোয়ারা, চট্টগ্রাম জেলায় স্থাপিত হয়। এ ফ্যাক্টরীর বার্ষিক উত্পাদন ক্ষমতা ৫,২৮,০০০ মেট্রিক টন।
বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সার কারখানা
একসময় বাংলাদেশের প্রথম সার কারখানা ন্যাচারাল গ্যাস ফার্টিলাইজার ফ্যাক্টরি সবচেয়ে বড় সার কারখানা হিসেবে খ্যাত ছিলো, যেটি বর্তমানে বিলুপ্ত। এখন শাহজালাল সার কারখানা হল বাংলাদেশের বৃহত্তম সার কারখানা। এটি সিলেট জেলার ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলার এনজিএফএফে অবস্থিত। বর্তমানে ইউরিয়া সারের চাহিদা প্রতিবছর এক মৌসুমে শুধু ৩০ লাখ মেট্রিক টন। এই চাহিদা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাই এ চাহিদা মেটানোর জন্য বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে ফেঞ্চুগঞ্জে শাহজালাল সার কারখানা নামে আধুনিক প্রযুক্তিসম্পন্ন, শক্তি সাশ্রয়ী এবং পরিবেশবান্ধব সার কারখানা নির্মাণের পদক্ষেপ নেয়া হয় যেটি এখন দেশের সর্ববৃহৎ সার কারখানা হিসেবে পরিচিত।
বাংলাদেশের প্রথম সার কারখানা
বাংলাদেশ তথাপি এশিয়ার প্রথম সার কারখানা হলো “ন্যাচারাল গ্যাস ফার্টিলাইজার ফ্যাক্টরি লিমিটেড”(ফেঞ্চুগঞ্জ সার কারখানা)। যেটি সংক্ষেপে এনজিএফএফ (NGFF) নামে পরিচিত। বিরাট একরের জায়গায় অবস্থিত চমৎকার পরিবেশে বাংলাদেশের প্রথম সার কারখানাটি নির্মাণ করা হয়েছিলো।
ফেঞ্চুগঞ্জ সার কারখানার অবস্থান
বহু বছরের পুরনো এ কারখানাটি ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলা হতে প্রায় ০৫ কিলোমিটার দক্ষিণে সিলেট-মৌলভীবাজার হাইওয়ে রোডের পূর্ব দিকে হাইওয়ে রোড হতে ০১ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। দেশের প্রথম ও সর্ববৃহৎ এ সার কারখানাটির অবস্থান ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলার মাইগাঁও ইউনিয়নে। ফেঞ্চুগঞ্জ থেকে সার কারখানার দূরত্ব খুব একটা বেশি নয়। আর সিলেট শহর থেকে প্রায় ৪০ কিলোমিটার দক্ষিণে, পাহাড় টিলা জঙ্গল আর চা বাগান দিয়ে ঘেরা নয়নাভিরাম এলাকায় গড়ে ওঠা এক আশ্চর্য নাগরিক সভ্যতা বাংলাদেশের এই প্রথম সার কারখানা।
ফেঞ্চুগঞ্জ সার কারখানায় যেভাবে যাবেন
যেকোনো শহর থেকে সিলেট শহরে পৌঁছানোর পর ফেঞ্চুগঞ্জ যাওয়ার জন্য লোকাল পরিবহনে তিন ভাবে যাওয়া যায়।
১. সিলেটের কদমতলী বাস স্ট্যান্ড থেকে ভাটেরার লোকাল বাসে উঠে বসলে ৩০টাকা ভাড়া দিয়ে সরাসরি ফেঞ্চুগঞ্জ সার কারখানার কোয়ার্টারে প্রবেশের গেইটে (যেটি স্থানীয়ভাবে “রেলগেইট” নামে পরিচিত) পৌঁছে যাওয়া যায় এবং সেখানে বাসা থামে। তারপর কলোনীর কোয়ার্টারে প্রবেশ করলেই সারি সারি গাছ আর সুন্দর রাস্তা ধরে ৬-৭ মিনিট হেঁটে গেলেই কলোনীর বাজারের পাশেই বিরাট এরিয়ায় ফেঞ্চুগঞ্জ সার কারখানা।
২. সিলেট রেলওয়ে স্টেশন থেকে মাইজগাঁওগামী লোকাল ট্রেনে স্বল্প ভাড়ায় ফেঞ্চুগঞ্জ সার কারখানায় পৌঁছানো সম্ভব। ট্রেন মাইজগাঁও থামলে সেখান থেকে সিএনজিতে ক’রে সরাসরি ফেঞ্চুগঞ্জ সার কারখানায় পৌঁছে যাওয়া যায়।
৩. সিলেট হুমায়ুন চত্বরের লোকাল সিএনজিতে ৩৫ টাকা ভাড়ায় ফেঞ্চুগঞ্জের ফেরিঘাটে এসে থামলে সেখান থেকে আবার সিএনজি করে পালবাড়ি এবং তারপর পালবাড়ি থেকে আবার সিএনজি ক’রে ফেঞ্চুগঞ্জ সার কারখানায় যাওয়া যায়। কিংবা ফেরিঘাট থেকে সরাসরি ফেঞ্চুগঞ্জ সার কারখানাবাজার পর্যন্তও যাওয়া সম্ভব।
এছাড়াও সিএনজি রিজার্ভ করে সিলেট শহর থেকে ৫০০-৬০০ টাকা ভাড়ায় ফেঞ্চুগঞ্জ সার কারখানায় পৌঁছানো যায় খুব সহজেই।
ফেঞ্চুগঞ্জ সার কারখানার অতীত ইতিহাস
চা-বাগানের মায়ায় জড়ানো মন জুড়িয়ে যাওয়া এক সবুজ মফস্বল শহরের অসাধারণ পরিবেশে ফেঞ্চুগঞ্জ সার কারখানানির্মিত হয়েছিলো। সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলার মাইজগাঁও ইউনিয়নে ১৯৬১ সালে স্থাপন করা হয় ‘ন্যাচারাল গ্যাস ফার্টিলাইজার ফ্যাক্টরি লিমিটেড’। জাপানের কোবে স্টিল কোম্পানি এটিকে জাপানি প্রযুক্তি দ্বারা নির্মাণ করে। শুরুতে এই কারখানা থেকে প্রতিদিন গড়ে ৩০০ মেট্রিক টন ইউরিয়া সার উৎপাদন হতো। পরবর্তীতে ১৯৬৯ সালে এ্যামোনিয়াম সালফেট প্ল্যান্টটি স্থাপন করা হয়েছিল। এ ফ্যাক্টরীর বার্ষিক উৎপাদন ক্ষমতা ছিলো ১ লক্ষ ৬ হাজার মেট্রিক টন।
এনজিএফএফ লিঃ আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করা হয় ১৯৬২ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন প্রেসিডেন্ট কর্তৃক। সার কারখানা১৯৬২ সালে উদ্বোধন করা হলেও এর প্রাথমিক কার্যক্রম শুরু হয় ১৯৫৬ সাল থেকে। ১৯৫৮ সাল থেকে পুরোদমে কাজ শুরু হলে ধীরে ধীরে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সংখ্যা বাড়তে থাকে। ওই পর্যায়ে তিনটি প্রতিষ্ঠানের জনবল ছিলো সেখানে। প্রথমত এনজিএফএফ লিঃ, দ্বিতীয়ত কোবে স্টিল ওয়ার্কস, তৃতীয়ত মিতসুবিশি ইলেকট্রিক্যাল লিঃ। ধীরে ধীরে কোয়ার্টার তৈরি হতে থাকে-এই তিন প্রতিষ্ঠানে কর্মরতদের পরিবার আসতে শুরু করে।
একটা সময় শুধুমাত্র ফেঞ্চুগঞ্জ সার কারখানা পরিদর্শন করতে দূর দূরান্ত থেকে পর্যটকেরা ভীড় জমাতেন। এতোই মনোরম পরিবেশে এ কারখানাটি পরিপাটি কলোনী কোয়ার্টারের ভেতর ছিলো, যেখানে কোয়ার্টারে প্রবেশের রাস্তা জুড়েই সারি সারি কৃষ্ণচূড়া গাছ ঠায় দাঁড়িয়ে থাকতো এবং বসন্ত আসলেই কৃষ্ণচূড়া ফুল লাল কার্পেটের মতোন বিছিয়ে থাকতো রাস্তায়। তাই প্রবেশের পথেই মন কেড়ে নিতো এই নিরিবিলি প্রাকৃতিক পরিবেশের ফেঞ্চুগঞ্জ সার কারখানার পথটি।
একসময় ফেঞ্চুগঞ্জ সার কারখানার বিশাল বাউন্ডারির ভেতর নিজস্ব কোয়ার্টার হয় যা বিআইডিসি (বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডেভলপমেন্ট কর্পোরেশন) নামে পরিচিত এবং সেখানে কারখানার সকল পর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আলাদা বাসায় পরিবারসহ থাকার ব্যবস্থা ছিলো। সবচেয়ে মজার তথ্য হলো, দীর্ঘকাল চাকরীর সুবাদে সেই কলোনীর একই বাসায় জন্মের পর থেকে বংশ পরম্পরায় তিন প্রজন্মের বসবাসের ইতিহাসও আছে। এছাড়াও কোয়ার্টারের ভেতর দুটি হাসপাতাল (ইনডোর এবং আউটডোর), এমপ্লয়িজ ক্লাব, আনসার ক্যাম্প, সোনালী ব্যাংক, কিন্ডারগার্ডেন স্কুল, ন্যাচারাল গ্যাস ফার্টিলাইজার ফ্যাক্টরি স্কুল, বিআইডিসি বাজার, খেলার বড় মাঠ, বড় জামে মসজিদ ও গার্ড ব্যারাক মসজিদ, ইসলামী সংঘ, সিনেমা হল “ছায়ানীড়”, শিশুপার্ক, চোখ ধাঁধানো এমডি বাংলো, অপূর্ব একটি অতিথি ভবন, অফিসার্স ক্লাব এবং কলোনীর গা ঘেঁষে থাকা বিখ্যাত মনিপুর চা-বাগান ছিলো।
ইতিহাস খুঁজে বের করে জানা যায় ৭০ এর দশকে সাড়া জাগানো বাংলা ছায়াছবি ‘বিনিময়’ চলচ্চিত্রের শুটিং হয়েছিল এ ফেঞ্চুগঞ্জ সার কারখানায়। এই ছায়াছবির প্রায় আশিভাগ শুটিং হয়েছিলো এ ফেঞ্চুগঞ্জে। এছাড়াও সার কারখানাকলোনীর বড় মাঠের জনপ্রিয় প্যাভিলিয়নে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর তৎকালীন সর্বাধিনায়ক আইয়ুব খান এসে বক্তব্য রাখেন এবং তখন থেকেই জায়গাটি “আইয়ুব খানের প্যাভিলিয়ন” নামে পরিচিত। এছাড়াও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক রাষ্ট্রপতি এরশাদ, দীলিপ বড়ুয়া সহ বিভিন্ন মন্ত্রী এনজিএফএফের অতিথি ভবনে এসে থেকেছেন। সার কারখানা মাঠে ১৯৭৪ এর শেষদিকে এসেছিলেন জাপানের শিল্পমন্ত্রী মিঃ ও পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী তাকাশি হাওয়াকাওয়া। জাপানি সংসদ সদস্য ও মন্ত্রী তাকাশি হায়াকাওয়া তাঁর ‘আমার বাংলাদেশ’(অনুবাদ- প্রথমা প্রকাশন) নামে একটি বই লিখেছেন । সেখানে ফেঞ্চুগঞ্জ সার কারখানার কথাও লিখেছেন, বলেছেন- “…সেই সময় ফেঞ্চুগঞ্জ শহর পরিদর্শনে যাওয়ার সুযোগ হয়, যেখানে জাপানের সাহায্যে নির্মিত সার কারখানা রয়েছে এবং তার সংস্কারের কাজ চলছিল। সেখানে হাজার হাজার নাগরিক আমাকে আন্তরিকভাবে গ্রহণ করেন এবং ছেলে মেয়েরা কুচকাওয়াজ করে আমাকে স্বাগত জানায়।”
ফেঞ্চুগঞ্জ কারখানার ইতিহাস ঘাঁটলে তাঁর পাতায় পাতায় সেই সময়কার চমৎকার খন্ড খন্ড স্মৃতি খুঁজে পাওয়া যায়। হোমার তাঁর “কারখানা স্মৃতি” কবিতায় এনজিএফএফ এর প্রতিষ্ঠার ইতিহাস বর্ননা করেছেন খুব চমৎকারভাবে, ১৯৬১-র ১৩ই ডিসেম্বর পরীক্ষামূলকভাবে প্রথম সার উৎপাদিত হয়েছিল এই কারখানায়। তারই বর্ননা আছে সেখানে ছন্দের বুননে-
“দেশী ও বিদেশী হাজারো লোকের হাড় ভাংগা খাটুনীতে,
প্রস্তুত হল এই কারখানা মজবুত গাঁথুনীতে,
পাঁচ সাল বাদে,একষট্টির তেরই ডিসেম্বর
শুভ ক্ষণে ঝরে পড়ল একদা ইউরিয়া ঝর ঝর।
পাশে টিলা পাখী বহরে ময়ূর শাহের রুহানী তেজে, নব নির্মিত কার খানা গেটে সাইরেন উঠে বেজে।”
ফেঞ্চুগঞ্জ সার কারখানার খুব পুরোনো রীতি ছিলো রমজান মাসে ইফতারের সময় হলে এবং সেহরির সময় হলে কারখানা থেকে সাইরেন বেজে ওঠা। আজানের সময় সাইরেন ভেসে আসতো কারখানা থেকে। অফিসের কর্মচারীরা এবং কলোনীবাসী সেই সাইরেনের শব্দে ইফতার এবং সেহরির গ্রহণে অভ্যস্ত ছিলো। যারা চাকরীর পর কারখানার কলোনী ছেড়ে চলে গেছেন তাদের ভাষায় বললে, এই সাইরেন ছিলো তাদের একটি আবেগ৷ তাই এখান থেকে চলে যাবার পর বুড়ো সাইরেনের শব্দ শুনতে না পারার হাহাকার তাদের স্মৃতিকাতর করে দেয়। সেখানকারই কবি লিখেছিলেন-
“পাহাড়ের ফাঁকে কুশিয়ারা বাঁকে
সারের এ কারখানা
উড়ু উড়ু মন এখানে স্বপন
রচে পেতে আস্তানা।”
এমনই নানান অনন্য আবেগ ও অনুভূতির ঝাঁপিতে স্মৃতির আঙিনা সিলেট জেলার চা-বাগান-টিলা বেষ্টিত ফেঞ্চুগঞ্জ সার কারখানাএবং তার এলাকা।
শীতকালে বুক ভরে টেনে নেয়া কুয়াশামাখা ভারী বাতাসের সেই মনোরম এলাকা আর অজস্র স্মৃতির জনপদের সেই বুড়ো কারখানার গর্জন সবই আজ অতীত। টিলার চূড়ায়, মাঠের কোণেতে, এলাকার অলিগলিতে হাজারো স্মৃতির বাক্স হৃদয়ে জমিয়ে রেখে সেই ঐতিহাসিক ফেঞ্চুগঞ্জ সার কারখানাচিরকাল অমলিন হয়ে থাকবে সেখানকার মানুষের কাছে। এশিয়ার প্রথম এই সার কারখানার অতীত ইতিহাস মনে রাখবে সকলেই।
আরো পড়ুনঃ সিলেট মাজার সম্পর্কে জানা-অজানা সব তথ্য
ফেঞ্চুগঞ্জ সার কারখানার বর্তমান অবস্থা
এ কারখানাটি বহু বছর দেশের সারের চাহিদা পূরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখলেও দিন দিন যন্ত্রপাতি পুরনো হয়ে যাওয়ায় ও প্রযুক্তির দিক দিয়ে পিছিয়ে পড়ায় কমতে থাকে উৎপাদন। এদিকে দীর্ঘদিন ধরে পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে থাকা সারকারখানাটি সংস্কার করে পুনরায় চালু না করে বিলুপ্ত ঘোষণা ও বিক্রির সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। এসএফসিএল চালু হবার পর বেশ দীর্ঘদিন পরিত্যাক্ত অবস্থায় পড়ে ছিলো ঐতিহাসিক ফেঞ্চুগঞ্জ সারকারখানা। এরপর ১১ আগস্ট, ২০২১ সালে দ্বিতীয় দফায় ফের নিলামে দ্বিগুণ দামে বিক্রি হয়েছে ফেঞ্চুগঞ্জের ন্যাচারাল গ্যাস ফার্টিলাইজার ফ্যাক্টরি (এনজিএফএফএল)। সর্বোচ্চ দরদাতা প্রতিষ্ঠান হিসেবে নিলামে ২১১ কোটি ৪০ লাখ ২৫ হাজার টাকা দিয়ে পুরাতন সারকারখানাটি স্ক্রেপ হিসেবে কিনে নেন মেসার্স সাইদুর রহমান। মহা ব্যবস্থাপক বাণিজ্যিক সেরনিয়াবাত রেজাউল বারী ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পক্ষে সর্বোচ্চ দরদাতা হিসেবে প্রতিষ্ঠানটির নাম ঘোষণা করেন।
দরপত্রে অংশগ্রহণকারীদের সামনে বাঁছাইকালে উপস্থিত ছিলেন এনজিএফএফএর ব্যবস্থাপনা পরিচালক ওমর ফারুক ও দরপত্র মূল্যায়ন কমিটির চেয়ারম্যান এনজিএফএফএর জিএম (প্রশাসন) এ টি এম বাকী। দরপত্রে অংশগ্রহণকারী অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বিএন করপোরেশন ২০৫ কোটি ৬০ লাখ টাকা, তৃতীয় সর্বোচ্চ হয় খায়রুল অটো ফ্লাইঅভার মিল ১৫২ কোটি টাকা। এছাড়া দরপত্রে অংশগ্রহণকারী অন্য প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সেন্ট্রাল বাংলা কোরিয়ার অ্যান্ড পার্সেল লিমিডেট ১৪৯ কোটি টাকা, কমার্সিয়াল নেটওয়ার্ক নিউজ বাংলাদেশ ১৪২ কোটি ৭৫ লাখ টাকা, রেপিড সোর্স ১৩২ লাখ ৫২ লাখ ৯০০ টাকা, মেসার্স আল মাসুম ট্রেডার্স ১৩১ কোটি টাকা, ডিডি ফিসারিজ ১২১ কোটি ২১ লাখ ২১ টাকা, মেসার্স নিজামুল আলম ১১৯ কোটি ৮৯ লাখ ৮৯ হাজার টাকা, আলম ল্যান্ড ফাউন্ডেশন প্রাইভেট ১১২ কোটি টাকা, নুর আলম অ্যান্ড ব্রাদার্স ১১০ কোটি ৫৫ লাখ টাকা, বিনসেন কনসালটেন্সি ১০৭ কোটি ৯২ লাখ টাকা, এসএস স্টিল লিমিটেড ১০৬ কোটি ১০ লাখ টাকা এবং ফয়ছল অ্যান্ড কোম্পানি সামিট অ্যাসোসিয়েট ৬৪ কোটি টাকা দরপত্রে উল্লেখ করেন।
প্রথমবারের মতো গত বছরের ২ সেপ্টেম্বর (এনজিএফএফএল) বিক্রির জন্য দরপত্র আহ্বান করে কর্তৃপক্ষ। সে সময় মেসার্স আতাউল্লাহ গ্রুপ সর্বোচ্চ দরদাতা হিসেবে ১০৩ কোটি ৭৫ হাজার টাকা দিয়ে কারখানাটি স্ক্রেপ হিসাবে কিনে নেন। কিন্তু নিয়মমাফিক টাকা জমা না করায় এটি আদালত পর্যন্ত গড়ায়। আদালতের বেঁধে দেওয়া সময়েও টাকা জমা দিতে না পারেনি দরদাতা প্রতিষ্ঠানটি। অবশেষে পুনরায় নিলামের সিদ্ধান্ত নেয় শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ বিসিআইসি।বিসিআইসির অধীনস্থ ফেঞ্চুগঞ্জ সার কারখানার মহাব্যবস্থাপক (বাণিজ্যিক) সেরনিয়াবাত রেজাউল বারী ২৫ মে ব্যবস্থাপনা পরিচালক ওমর ফারুকের পক্ষে দরপত্র আহ্বান করেন। পরদিন ২৬মে দরপত্র আহ্বান করে বিভিন্ন গণমাধ্যমে বিজ্ঞপ্তি প্রচার করা হয়। এরপর ১১আগস্ট দুপুরে টেন্ডার খোলার হয় এবং বাছাই শেষে সর্বোচ্চ দরদাতা প্রতিষ্ঠান হিসেবে উঠে আসে মেসার্স সাইদুর রহমান নামক প্রতিষ্ঠানের নাম। বর্তমানে ফেঞ্চুগঞ্জ সার কারখানাটি মেসার্স সাইদুর রহমান প্রতিষ্ঠানের সম্পত্তি।
শাহজালাল সার কারখানা
শাহজালাল ফার্টিলাইজার কোম্পানি লিঃ শিল্পমন্ত্রণালয়ের আওতাধীন বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ কর্পোরেশন (বিসিআইসি) এর নিয়ন্ত্রাধীন দেশের সর্ববৃহৎ আধুনিক শক্তি সাশ্রয়ী ও পরিবেশ বান্ধব সার কারখানা। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১২ সালের ২৪ মার্চ এই কারখানার ভিত্তি প্রস্তর স্থাপনের মধ্য দিয়ে এই ঐতিহাসিক কাজের শুভ উদ্বোধন করেন। বাস্তবায়নকারী সংস্থা বাংলাদেশ রসায়ন শিল্পসংস্থা (বিসিআইসি) ও শিল্প মন্ত্রণালয়। বাংলাদেশ ও চীন সরকারের যৌথ অর্থায়নে প্রায় ৪১৮ একর জায়গায় ওপর এটি নির্মিত হয়৷ প্রকল্পের প্রাক্কলিত ব্যয় ৫৪০৯ কোটি টাকা, যার মধ্যে চীন সরকারের প্রকল্প সাহায্য ৩৯৮৬ কোটি টাকা এবং বাংলাদেশ সরকারের ১৪২৩ কোটি টাকা। কারখানাটির দৈনিক উৎপাদন ক্ষমতা ১৭৬০ মেট্রিক টন গ্রানুলার ইউরিয়া সার ও ১০০০ মেট্রিক টন তরল অ্যামোনিয়া এবং এর বার্ষিক উৎপাদন ক্ষমতা ৫ লক্ষ ৮০ হাজার ৮’শ মেট্রিক টন গ্রানুলার ইউরিয়া সার ও ৩ লক্ষ ৩০ হাজার মেট্রিক টন তরল অ্যামোনিয়া।
২০১৬ সালের পহেলা মার্চ থেকে এর বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু হয়। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং চীন সরকারের মহামান্য প্রেসিডেন্ট শিং জিং পি কর্তৃক কারখানাটির শুভ উদ্বোধন ঘোষণা করা হয় ১৪ অক্টোবর, ২০১৬।
শাহজালাল সার কারখানার বর্তমান অবস্থা
শাহজালাল ফার্টিলাইজার কোম্পানি লিঃ সংক্ষেপে যেটি এসএফসিএল(SFCL) নামে পরিচিত, এর সার্বিক উৎপাদন প্রক্রিয়া পদ্ধতিগত কারণে চারটি প্ল্যান্টে বিভক্ত করা হয়েছে।
- ইউটিলিটি
- অ্যামোনিয়া
- ইউরিয়া
- ব্যাগিং ও সলিড হ্যান্ডলিং।
বর্তমানে পরিকল্পনা মাফিক সঠিকভাবে কারখানার কাজকর্ম চলমান রয়েছে।
যেমনঃ শাহজালাল ফার্টিলাইজার কোম্পানি লিঃ এ গ্রানুলার ইউরিয়া সার উৎপাদনের জন্য প্রধান কাঁচামাল হিসেবে প্রাকৃতিক গ্যাস, প্রাকৃতিক বাতাস এবং বাষ্প ব্যবহার করা হয়। উল্লিখিত তিনটি কাঁচামাল সরাসরি ইউরিয়া সার উৎপাদনে সংশ্লিষ্ট নয়। বিভিন্ন পদ্ধতির মাধ্যমে উক্ত কাঁচামাল থেকে কার্বন-ডাই-অক্সাইড এবং তরল অ্যামোনিয়া তৈরি করে এই দুটির সংমিশ্রণে ইউরিয়া উৎপাদন করা হয়। অ্যামোনিয়া প্ল্যান্টের মূল ভূমিকা হলো ইউরিয়া উৎপাদনের প্রয়োজনীয় কাঁচামাল তরল অ্যামোনিয়া ও কার্বন-ডাই-অক্সাইড তৈরি করা।
এভাবে চারটি প্ল্যানটিই ভিন্ন ভিন্ন প্রক্রিয়ায় নিজ গতিতে শ্রমিকদের কাজের মাধ্যমে কারখানাটিকে সুষ্ঠুভাবে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। উৎপাদিত পণ্যের গুণগতমান সহ প্রসেসের বিভিন্ন ধাপে প্রসেস প্যারামিটার গুলো মনিটরের জন্য অনলাইন অ্যানালাইজার রয়েছে তথাপি প্রসেসের বিভিন্ন ডিজাইন প্যারামিটার এরবকাউন্টার চেকিং এবং গুণগতমান সর্বদা অক্ষুণ্ণ রাখার স্বার্থে প্রসেসের বিভিন্ন স্যাম্পল পয়েন্ট থেকে স্যাম্পল সংগ্রহ করে অত্যাধুনিক ইক্যুইপমেন্টস সমৃদ্ধ ল্যাবরেটরিতে বিশ্লেষণ করে গুণগতমান নির্ণয় করা হয়। কারখানার উৎপাদিত সার সর্বদা বিএসটিআই ও আন্তর্জাতিক ডিজাইন মান অনুসরণ করে বাজারজাত করা হয়।
কারখানার উৎপাদিত সার বিপণনের জন্য কারখানার অধীনে সিলেট বিভাগের ৪টি জেলা-
১. সিলেট ২. সুনামগঞ্জ ৩. মৌলভীবাজার ও ৪. হবিগঞ্জ নিয়ে নিজস্ব কমান্ড এরিয়া রয়েছে। এসব কমান্ড এরিয়ার ডিলারগণ কারখানা থেকে সরাসরি সার উত্তোলন করে কৃষকের কাছে পৌঁছে থাকেন। তাছাড়া কারখানার উৎপাদিত সার সারাদেশে বিপণনের জন্য দেশের বিভিন্ন স্থানে ৬টি বাফার গোডাউন যথা- শিরোমণি খুলনা, রাজশাহী, শান্তাহার বগুড়া, পার্বতীপুর দিনাজপুর, চরখাই দিনাজপুর ও ঠাকুরগাঁও-এ মজুদ করা হয় এবং ডিলারদের মাধ্যমে বিভিন্ন জায়গায় সরবরাহ করা হয়।
ইউরিয়া সার সরাসরি কৃষি তথা দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের সাথে সংশ্লিষ্ট। কৃষি প্রধান বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে ইউরিয়া সার অত্যাবশ্যক। কারখানায় উৎপন্ন ইউরিয়া সার ব্যবহারের ফলে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে এবং উৎপন্ন সার খাদ্য উৎপাদনে সহায়ক ভূমিকা রাখবে। তাই বাংলাদেশের সার কারখানাগুলো এগিয়ে যাক নিজস্ব ধারাবাহিকতায় এবং আমাদের দেশের অর্থনৈতিক অবস্থাকে সমৃদ্ধশালী করুক, নাগরিক হিসেবে এটিই আমাদের কাম্য।
বিঃদ্রঃ এই ব্লগের প্রত্যেকটা ব্লগ পোস্ট Sylhetism ব্লগের নিজস্ব ডিজিটাল সম্পদ। কেউ ব্লগের কোন পোস্ট কিংবা আংশিক অংশ ব্লগের কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া কপি পেস্ট করে অন্য কোথাও প্রকাশ করলে ব্লগ কর্তৃপক্ষ ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনে মামলা করার অধিকার রাখে। এবং অবশ্যই কপিরাইট ক্লাইম করে যে মাধ্যমে এই ব্লগের পোস্ট প্রকাশ করা হবে সেখানেও অভিযোগ সাবমিট করা হবে।
ধন্যবাদ, ব্লগ কর্তৃপক্ষ।