জয়নুল আবেদিন, বাংলাদেশের অন্যতম এক নক্ষত্রের গল্প ২০২৪

জয়নুল আবেদিন

Last Updated on 7th April 2024 by Mijanur Rahman

বাংলাদেশের চিত্র শিল্পীদের কথা উঠলেই প্রথমে যেই শিল্পীর নাম সবার মাথায় আসে তাহলো শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন (Zainul Abedin)। বাংলাদেশের এই মহৎ শিল্পী জয়নুল আবেদিন শিল্প আন্দোলনের পিছনে মূল ব্যক্তি হিসেবে ছিলেন। যিনি ১৯৪৩ সালের বাংলার দুর্ভিক্ষের ছবি দিয়ে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। ১৯৪৭ সালে ভারত থেকে পাকিস্তান বিভক্ত হওয়ার পর, তিনি তার চারপাশের শিল্পীদের একসাথে করতে সক্ষম হন। তারা শিল্পের বিভিন্ন কাজ নিয়ে গবেষণা করতেন। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন সম্পর্কে একটা কথা নিঃসংকোচে বলা যায় যে তিনি নিজেই ছিলেন একটি ইনস্টিটিউট।  ঢাকা আর্ট কলেজ, ময়মনসিংহ জয়নুল সংগ্রহশালা, বাংলাদেশ লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশন এর সূচনা তার হাত ধরে হয়েছিল।  তিনি তার প্রতিটি কাজে স্বদেশী ঐতিহ্য, এশিয়া এবং ইউরোপে শিল্প বৈশিষ্ট্যের সমন্বয় ঘটিয়েছেন। তাকে বাংলাদেশের চারু ও ব্যবহারিক কারুকলার প্রাতিষ্ঠানিক প্রতিষ্ঠাতা হিসেবেও গণ্য করা যায়। তাহলে চলুন আজকে জেনে নিন শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্যঃ

জয়নুল আবেদিনের জন্মঃ

জয়নুল আবেদিন বৃহত্তর ময়মনসিংহ (তৎকালীন মহকুমা শহর) বর্তমান কিশোরগঞ্জ জেলায় কেন্দুয়াতে ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দের ২৯ ডিসেম্বর জন্মগ্রহণ করেন। তার আদি নিবাস ছিল পাবনায়। তাঁর পিতার নাম তমিজউদ্দিন আহাম্মেদ। যিনি ছিলেন পুলিশের দারোগা (সাব-ইন্সপেক্টর)। তার মাতার নাম জয়নাবুন্নেছা। উনি একজন সাধারণ গৃহিণী ছিলেন। নয় ভাইবোনের মধ্যে জয়নুল আবেদিন ছিলেন সবার বড়। ১৯২৬ সালে ১২ বছর বয়সে তার পরিবার ময়মনসিংহ শহরের আকুয়া মাদ্রাসার কোয়ার্টারের বাড়িতে চলে আসেন। ব্রহ্মপুত্র নদীর তীরে কাটতে থাকে তার শৈশব। বলা হয়ে থাকে তার শিল্পকর্মের শুরুটা হয়েছিল ব্রহ্মপুত্র নদীর কারণে। এই নদীর সৌন্দর্য তার ভেতরের শিল্প প্রতিভাকে জাগিয়ে তুলেছিল। গ্রাম বাংলার মানুষ, তাদের জীবনযাত্রা এবং বাংলার প্রকৃতি খুব ছোট থেকেই তাকে আকৃষ্ট করে। সময় পেলেই তিনি ঘর থেকে বেরিয়ে ছুটে যেতেন নদীতীরে। খৈরঙা পালের নৌকাগুলোর ছোটা, কলসিকাঁখে পল্লিবালাদের জল নিয়ে যাওয়া মুগ্ধ নয়নে তিনি দেখে যেতেন। রং পেনসিল, কাগজ নিয়ে তার দেখা দৃশ্যগুলোর ছবি আঁকার চেষ্টা করতেন। সেজন্য ছোট থেকেই জয়নুল পড়াশোনার চেয়ে ছবি আঁকার প্রতি বেশি আগ্রহী ছিলেন। পাঠের সময় তিনি তার পাঠ্যপুস্তকে ছবি আঁকতেন।

জয়নুল আবেদিনের শিক্ষাজীবনঃ

লেখাপড়ায় জয়নুল আবেদিন বেশি ভালো ছাত্র ছিল না। উনার প্রাথমিক শিক্ষা জীবন শুরু হয়েছিল নিজ শহরের পন্ডিত পাড়া পাঠশালায়। যখন তারা বাসা বদল করলো তারপরে তিনি ভর্তি হন ময়মনসিংহ জেলা স্কুল এবং মৃত্যুঞ্জয় ইংলিশ হাইস্কুলে। যেহেতু জয়নুল আবেদিনের প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনার থেকে চিত্রাঙ্কনে বেশি আগ্রহ ছিল সেহেতু তার মা তাকে সবসময় অনুপ্রেরণা দিত। এমনকি যখন তার প্রতিভা দেখে জেলা বোর্ডই কলকাতা আর্ট কলেজে তাঁর শিক্ষাকালের প্রথম পর্যায়ের অতি জরুরি বৃত্তি প্রদান করে তখন উনার মা তার সোনার হার বিক্রি করে তাকে কলকাতায় আর্ট কলেজে পড়াশোনা করাতে পাঠান। যার ফলে ১৯৩৩ সালে এসএসসি পরীক্ষার পূর্বেই তিনি কলকাতা চলে যান এবং সেখানে কলকাতায় সরকারি আর্ট স্কুলে ভর্তি হন। ১৯৩৮সালে পাঁচ বছরের অধ্যায়ন শেষে কলকাতা সরকারি আর্ট কলেজের ড্রয়িং এন্ড পেইন্টিং ডিপারমেন্ট থেকে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম স্থান অধিকার করে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। তার অসাধারণ প্রতিভার কারণে তিনি সেখানে ছাত্র থাকাকালীন আর্ট স্কুলের শিক্ষক নিযুক্ত হন। এমনকি তিনি ১৯৫১-৫২ সালে স্ল্যাড স্কুল অফ আর্টস, লন্ডনে পড়াশোনা করেন।

জয়নুল আবেদিনের কর্মজীবনঃ

বাংলাদেশের শিল্প বিশ্ব দরবারে তুলে ধরার ক্ষেত্রে সবচেয়ে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে জয়নুল আবেদিন। তার কর্মজীবনের পুরোটাই কেটেছে বাংলাদেশের শিল্পের একটি নিজস্ব পরিচয় তৈরি করতে। তিনি বিশ্বাস করতেন শিল্প নিছক শিল্পের জন্য নয়, শিল্প সর্বাংশে জীবনের জন্য। আর সেজন্যই বোধ হয় তিনি তার জীবনের ২৯ বছর বাংলাদেশের শিল্পী আন্দোলনের সাথে ছিলেন।

  • জয়নুল প্রথম জীবনে বাড়তি আয়ের জন্যে বইপত্রের অলংকরণ করেছেন। তার অলংকৃত বইয়ের তালিকাঃ জসীম উদ্দীনের বালুচর, আহসান হাবীবের রাত্রিশেষ, আবুল মনসুর আহমদের আয়না, শামসুদ্দীন আবুল কালামের কাশবনের কন্যা, শওকত ওসমানের বনি আদম (প্রথম প্রকাশ আজাদ ১৯৪৬), সরদার জয়েন উদ্দীনের নয়ান ঢুলী, শামসুল হুদা চৌধুরীর ময়ূখ এবং কল্যাণী দত্তের ছোটদের সচিত্র কৃত্তিবাস।
  • ১৯৪৮ সালে জয়নুল আবেদিন পাকিস্তানের রাজধানী করাচিতে কেন্দ্রীয় তথ্য ও প্রচার বিভাগের প্রধান নকশাবিদ হিসেবে কাজ শুরু করেন। যদিও  তিনি এই কাজটি এক বছরের বেশি করেননি।
  • ১৯৪৭ সালে ভারত পাকিস্তান ভাগের পর জয়নুল আবেদিন কলকাতা থেকে ঢাকায় চলে আসেন। তিনি স্বদেশে ফিরেই তার শিল্পের সব অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগাতে চেয়েছেন। তিনি চেয়েছেন দেশের লোক ও কারুশিল্পকে আরো বিকশিত করতে।  তাই  স্বদেশে ফিরেই তিনি শিল্পকে আরো কিভাবে বিকাশিত করা যায় সে সম্পর্কে চিন্তা ভাবনা করতে থাকেন। তার প্রথমে মনে হতে থাকে দেশে শিল্প অধ্যায়নের জন্য একটি প্রতিষ্ঠান অনেক প্রয়োজন। ১৯৪৮ সালে তিনি পুরান ঢাকার জনসন রোডের ন্যাশনাল মেডিকেল স্কুলের একটি পুরাতুন কক্ষে গভর্নমেন্ট আর্ট ইন্সটিটিউট প্রতিষ্ঠা করেন। সেই সময়ের তুলনায় সামাজিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতায় তাঁর এই উদ্যোগটি ছিল রীতিমতো বিপ্লবাক্তক ঘটনা৷ জয়নুল আবেদিন কলেজ ক্যাম্পাসের নকশা নির্মাণের জন্য বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ স্থপতি মাজহারুল ইসলামকেই দায়িত্ব দিয়েছিলেন৷ বর্তমানে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউট। জয়নুল আবেদিন ছিলেন এই আর্ট ইন্সটিটিউট এর প্রথম শিক্ষক। ১৯৪৯ সালের  দিকে তিনি করাচি থেকে একেবারে স্বদেশে ফেরত আসেন এবং ১লা মার্চ আর্ট ইনস্টিটিউটে যোগদান করেন। তিনি শিল্পমনা মানুষদের খুঁজে বেড়াতে থাকেন। তাদেরকে এই ইনস্টিটিউটের ভর্তি হওয়ার জন্য আনেন। ইনস্টিটিউটের শুরুতে এখানকার ছাত্র সংখ্যা ছিল মাত্র ১৮। ১৯৫১ সালে এই আর্ট ইন্সটিটিউট সেগুনবাগিচা এবং ১৯৫৬ সালে শাহবাগে স্থানান্তরিত হয়। জয়নুল আবেদিন এর নিরন্তন পরিশ্রমের কারণে ১৯৬৩ সালে গভর্নমেন্ট আর্ট ইন্সটিটিউট এর নাম বদলে হয়ে যায় পূর্ব পাকিস্তান চারু ও কারুকলা মহাবিদ্যালয়। যা ততদিনে একটি প্রথম শ্রেণির সরকারি কলেজ হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। স্বাধীনতার পর ১৯৭১ সালে এটির নাম আবারো বদলে যায় এবং রাখা হয় ‘বাংলাদেশ চারু ও কারুকলা মহাবিদ্যালয়’। জয়নুল আবেদিন ১৯৪৮ সাল থেকে ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ চারু ও কারুকলা মহাবিদ্যালয় এর প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এই সময় তিনি দেশের  শিল্পকে উন্নত করতে প্রায় একাধিক একক প্রদর্শনী করেন।
  • ১৯৭০ সালে প্রায় ৫৬ বছর বয়সে তিনি মধ্যপ্রাচ্যের সমর ক্ষেত্রে আরব লীগের আমন্ত্রণে ছুটে যান। তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের ছবি আঁকার জন্য আল-ফাতাহ গেরিলাদের সাথে চলে যান যুদ্ধফ্রন্টে৷ একাধিক আরব দেশে তাঁর সেসব ছবির প্রদর্শনী হয়৷ তার এই ছবি মুক্তিযোদ্ধাদের অনুপ্রাণিত করেছিল। 
  • জয়নুল আবেদিন কিছুদিনের জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের ডিন হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। 
  • বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরে তিনি বাংলাদেশের সংবিধানের অঙ্গসজ্জার জন্য কাজে লেগে পড়েন। যদিও কিছু সমস্যার কারণে এবং জাদুঘর তৈরীর কাজের জন্য তিনি কাজটি সম্পূর্ণ করেন নাই। 
  • ১৯৭২ সালে জয়নুল আবেদিন বাংলা একাডেমীর সভাপতি নির্বাচিত হন। তিনি ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত এই পদে বহাল থাকেন এবং সেই সালে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমীর অন্যতম উপদেষ্টা মনোনীত হন। তার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের ফিলাডেলফিয়াস্থ ‘কংগ্রেস ফর ওয়ার্ল্ড ইউনিটি’র সদস্য নির্বাচিত হন এবং বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় অধ্যাপক নিযুক্ত হন। তিনি আমৃত্যু এই পদে অধিষ্ঠিত থাকেন৷
জয়নুল আবেদিন
জয়নুল আবেদিন এবং খাদেম হুসাইন ১৯৯৫

বিয়ে ও ছেলেমেয়ে:

জয়নুল আবেদিন ১৯৪৬ সালে ঢাকা নিবাসী তৈয়ব উদ্দিন আহমদের কন্যা জাহানারা বেগমেকে বিয়ে করেন। তিনি তিন পুত্রের পিতা৷ তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র সাইফুল আবেদিন স্থপতি, দ্বিতীয় পুত্র খায়রুল আবেদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভূগোল বিষয়ে এম.এ করেছে এবং কনিষ্ঠ পুত্র মঈনুল আবেদিন প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পানি-সম্পদ প্রকৌশলে স্নাতক ডিগ্রী অর্জন করেছে।

মানুষ হিসেবে জয়নুল আবেদিন কেমন ছিলেনঃ

কোন ব্যক্তির শিল্পকর্মকে অনুধাবন করতে হলে প্রথমেই জানতে হবে তিনি মানুষ হিসেবে কেমন ছিলেন। তাই শিল্পী জয়নুল আবেদিন এর পাশাপাশি ব্যক্তি জয়নুল আবেদিনকে জানাও অনেক জরুরী। জয়নুল আবেদিন অনেক সহজ সরল সাদাসিদে এবং প্রাণখোলা ব্যক্তি ছিলেন। তাই তো সমাজের যে কোন স্তরের মানুষ এর সাথেই অত্যন্ত স্বাচ্ছন্দে মেলামেশা করতে পারতেন সেই শক্তিধর ব্যক্তিত্ব হোক কিংবা দরিদ্র চাষী। তার সব শিল্পকর্মে প্রধানত তার আবেগ প্রতীয়মান। তাই তার সকল শিল্পকর্ম সহজেই সবার হৃদয়ে পৌঁছে যায় এবং সেগুলোর মধ্যে বাস্তব প্রতিচ্ছবি ফুটে উঠে। তার সম্পর্কে বলা হয় তার শিল্পবোধ সৌন্দর্য মুখি এবং কল্যাণ ধর্মী।

তিনি সাধারণ বাঙালির মতোই সাধারণ জীবনযাপন করতেন। তিনি ছিলেন উদার মনের মানুষ। সত্তরের প্রলয়ঙ্করী ঝড় উপকূলীয় এলাকায় আঘাত হানার ফলে ঝড় ও সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাসে প্রায় তিন লক্ষাধিক মানুষ মারা যায় এবং অগণিত মানুষ ভিটেবাড়ি ছাড়া হয়। এই সময় জয়নুল আবেদীন একটি রিলিফ টিম তৈরি করে সেই সব মানুষদের সাহায্য করতে ছুটে যান। এমনকি সেখানকার মানুষদের কিছু ছবিও তিনি পরবর্তীতে পৃথিবীবাসীর সামনে তুলে ধরেন। বাঙালি সুখের দুঃখের সকল সমস্যার কথা তিনি প্রতিবাদ করেছেন তার শিল্প কর্মের মাধ্যমে। মানবতাবোধ ও সমাজ সচেতন ও তার বহিঃপ্রকাশ অত্যন্ত গভীর ভাবে তার সব শিল্পকর্মে চোখে পড়ে। তিনি ছিলেন অত্যন্ত তীক্ষ্ণ অনুভব অনুভূতি সম্পন্ন একজন মানুষ। তাই তিনি তার শিল্পকর্মে সহজেই বাংলার লোকশিল্পের সহজ সরলীকরণ এবং বর্ণনামূলক আবেদন তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছেন। জয়নাল আবেদীনের এই মহত্বটা, স্পষ্ট বাদিতা, চারিত্রিক দৃঢ়তা এবং দেশের প্রতি স্বার্থহীন ভালোবাসাই তাকে মানুষ হিসেবে আরো বেশি মহান করে তুলেছে।

শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের শিল্পকর্মঃ

একজন শিল্পীর শিল্পকর্মকে অধ্যয়ন করতে হলে, জানতে হলে সেই শিল্পীর বিভিন্ন পর্বের সৃষ্টিসমূহকে বিবেচনা করতে হয় একই সঙ্গে সেই সময়কালের পরিবেশ-সমাজ সম্বন্ধেও ধারনা রাখতে হয়। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন জন্মগ্রহণ করেছিলেন একটি ছোট শহরে। শহর ও গ্রামের এক অপূর্ব মিশ্রণ তিনি নিজের ভিতরে তৈরি করতে পেরেছিলেন। তিনি দেখেছেন নদীতে ঘুরে বেড়ানো নৌকার সারি, মৎস্য শিকার সেই সাথে দেখেছেন আদিবাসী জীবন এবং গারো পাহাড়ের চূড়া স্পর্শ করা আকাশের সৌন্দর্য। জয়নুল আবেদীন একজন ইম্প্রেশনিস্ট এবং ন্যাচারাল লিস্ট। তিনি তার শিল্পকর্মে কল্পনার থেকে বাস্তবতাকেই বেশি প্রাধান্য দিতেন।

'Famine 1943', sketch by Zainul Abedin
‘Famine 1943’, sketch by Zainul Abedin

তিনি একজন প্রতিবাদী শিল্পী হয়েও কখনো তার শিল্পে উগ্র রঙের ব্যবহার করেনি। তিনি তার শিল্পে শান্ত এক রূপ তুলে ধরেন সবসময় যা যে কোন সাধারণ মানুষেরও হৃদয় স্পর্শ করবে। যেমনঃ তিনি প্রকৃতির সবকিছুকে ভালবাসলেও কাক পছন্দ করতেন না৷ কিন্তু কাকের ছবিই বার বার এঁকেছেন। ছবিগুলোও জীবন্ত ও প্রাণস্পর্শী এক রূপ পেয়েছে৷ আর এই ছবি দিয়ে তিনি মূলত সমাজের সুযোগসন্ধানী মানুষদেরকে বোঝাতে চেয়েছেন। যেখানে তিনি সার্থক হয়েছেন। জয়নুল আবেদিনের তেল রং এর কাজ গুলোকে মনে করা হয় জলচিত্রের ক্ষেত্রে দক্ষতা প্রমাণের এক প্রামাণ্য দলিল। জয়নুল আবেদিনের স্কেচ ড্রয়িং এ শাশ্বত জীবনের ইঙ্গিত আছে। পরিমিত পরিমাণের রং এবং রেখার বিন্যাস তার চিত্রকর্ম গুলোকে আরো বেশি অর্থবহ করে তুলেছে। জয়নুল আবেদিনের শিল্প চেতনার বিকাশকে চারটি স্তরে ভাগ করা যায়। প্রথমত ধারা ১৯৩৩ সাল থেকে ১৯৪২ সাল পর্যন্ত একাডেমিক বা ইম্প্রেশনিস্ট, দ্বিতীয় ধারা ১৯৪২-৪৩ এর দুর্ভিক্ষের উপর আঁকা স্কেচগুলো থেকে যে চিত্রকর্মগুলো ছিল সেগুলো ছিল খুব প্রকাশবাদী বা এক্সপ্রেশনিস্ট, তৃতীয় ধারা ১৯৪৭ উত্তর বাংলার লোকজ শিল্পধারাভিত্তিক চিত্রকলার প্রভাব এবং চতুর্থ ধারা বিগত দশকে অংকিত বিমূর্ত প্রকাশবাদী চিত্ররীতি। তার চিত্রকর্মের এই পরিবর্তন সেই সময়ের বাংলার বিভিন্ন ঘটনা, নিজ ঐতিহ্য ও নিজ জন-মানুষকে জানার কারণে সম্ভব হয়েছে। তাঁর শিল্পকর্মগুলো হলঃ

  • ছাত্রজীবনে জয়নুল আবেদিন ছবি আঁকা শুরু করে সাধারণত তার অভিজ্ঞতার সাথে কল্পনা সংমিশ্রণ ঘটিয়ে। তিনি ছাত্রজীবনে মূলত ব্রহ্মপুত্র নদের স্কেচ, শম্ভুগঞ্জ ঘাট, সাঁকো, পুল এই সব কিছু নিয়ে বেশি ছবি এঁকেছেন। মূলত কলকাতা আর্ট স্কুলে ভর্তি হবার পর থেকেই তার প্রথম স্তরের শিল্প চেতনার বিকাশ ঘটতে থাকে। মানুষ ও নিসর্গের প্রতি তার যে অনুভূতি ছিল সেগুলো সব সময় তার চিত্রকর্মে প্রকাশিত হত। এর সাথে ইউরোপীয় চিত্রকলার প্রচন্ড শক্তি তার চিত্রকর্মকে প্রভাবিত করে। স্কুলের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র থাকা অবস্থায় একটি চিত্র প্রদর্শনীতে তিনি বাঁশের সাঁকো শীর্ষক একটি ছবির জন্য অনেক প্রশংসা লাভ করেন। মূলত দেখা যায় যে তিনি কখনো সম্পন্ন কল্পনার নির্ভর থেকে ছবি আঁকান না। বাঁশের সাঁকো আঁকানোর পূর্বে তিনি বাঁশের সাঁকোতে চড়েছেন। তার এই বাস্তব স্মৃতি বা অভিজ্ঞতার সাথে কল্পনার রং মিশিয়ে তিনি তৈরি করেন তার শিল্প কর্ম। তাই তার ছবিগুলো হয় বাস্তবধর্মী ও ইম্প্রেশনিস্ট। পরবর্তীতে তিনি তার এই ছোটকালের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে অনেক চিত্রকর্ম করেন। যেমনঃ কলসি কাঁখে (১৯৫১), মাছ ধরা (১৯৫০) ইত্যাদি।
  • দুর্ভিক্ষ সংক্রান্ত চিত্রকর্মের মাধ্যমে জয়নুল আবেদিনের দ্বিতীয় পর্বের যাত্রা শুরু হয়েছিল। ১৯৪২-৪৩ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এবং এর সাথে তৎকালীন ইংরেজ শাসকদের বাঙ্গালীদের প্রতি  অবহেলায় বাংলা জুড়ে দেখা দিয়েছিল দুর্ভিক্ষ মহামারী। তখন জয়নুল আবেদিন উনত্রিশ বছরের এক প্রাণবন্ত শিল্পী।বাংলা জুড়ে শুরু হয় প্রচণ্ড খাদ্য সংকট। বাজারে চাল কিনতে পাওয়া গেলেও গরিব কৃষক শ্রেণীর মানুষদের চাল কেনার মতো টাকা  ছিলনা। যার ফলে ব্রিটিশ ইংরেজ, জমিদার মজুতদার এবং স্বার্থনেশি কিছু বাঙালিদের কারণে লাখ লাখ কৃষক ও দিনমজুর মারা গিয়েছে।  এই ঘটনা জয়নুল আবেদিন এর উপর গভীর প্রভাব ফেলে। সেই সময় তিনি সারাদিন ধরে কলকাতার পথে ঘুরে ঘুরে খাদ্যহীন–বস্ত্রহীন মানুষের দুর্দশার ছবি এঁকে বেড়াতে লাগলেন। “দুর্ভিক্ষ-১৩৫০” শিরোনামে তিনি দুর্ভিক্ষের ছবিগুলোকে একত্রিত করতে থাকেন। ১৩৫০ সন ব্যবহার করেন কারণ ইংরেজি সন দ্বারা ইংরেজদের রাজকার্য পরিচালিত হতো। আর যেহেতু দুর্ভিক্ষের মূল হোতা ছিল ইংরেজরা তাই সূক্ষ্মভাবে প্রতিবাদস্বরূপ তিনি সচেতন ভাবেই ১৩৫০ সন ব্যবহার করেছেন।  “দুর্ভিক্ষ-১৩৫০” এর মধ্যে একটি ছবি আছে যেখানে জয়নুল তুলে ধরেছে মায়ের সামনে বসে একটি শিশু শূন্য থালা চেটে খাচ্ছে। অগোছালো চুল নিয়ে মা অর্ধ নগ্ন অবস্থায় বসে আছেন। সেই মা এবং শিশুর পাশে তিনটা কাক আছে যারা আশেপাশে ঠুকরে খাবার মত কিছুই খুঁজে পাচ্ছে না। আরেকটি চিত্রে মা ও সন্তানকে দেখানো হয়েছে যেখানে মা সন্তানের দিকে খালি হাত বাড়িয়ে রেখেছে। অন্য একটি চিত্রে সন্তান কোলে মা এবং একটি পুরুষ  ডাস্টবিনের ভেতরের দিকে মাথা নিচু করে আছে।  আরেকটি খেলা দেখা যাচ্ছে ডাস্টবিনের পাশে শুয়ে আছে একটি অর্ধনগ্ন মহিলা। তার মুখের উপর এবং হাতের কাছে দুটি কাক যেন তার মৃত্যুর অপেক্ষায় আছে এবং পাশে ডাস্টবিনের কাছে একটি কুকুর। এই সবগুলো চিত্রে একটি অভিশপ্ত নগরের চিত্র ফুটে উঠেছে। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন তার দুর্ভিক্ষের এই চিত্র মনের মধ্যে মানুষ কুকুর এবং কাককে পাশাপাশি স্থান দিয়েছেন। তিনি তার চিত্রকর্মে বাস্তবের সঙ্গে যুক্ত করেছেন এক্সপ্রেশনিজম। এই এক্সপ্রেশনিজমের মানে হচ্ছে ব্যক্তিগত আবেগ এবং শারীরিক অভিব্যক্তিকে শিল্পীর নিজস্ব শৈলী অনুসারে মূর্ত করে তোলা।এর ফলে জয়নুল আবেদিনের দুর্ভিক্ষের চিত্রমালা প্রকাশ হয়েছে সেখানে দেখা যায় যায় খাদ্যের অভাবে মানুষের দেহ দীর্ঘ হয়ে গিয়েছে। যা এই ছবিগুলোকে যেমন বাস্তব তেমন ভয়াবহরূপে ফুটিয়ে তুলেছে।  জয়নুলের এই চিত্র মালের মধ্যে একটি নাগরিক চেহারা ও রয়েছে। যার প্রতীক হচ্ছে ডাস্টবিন। ডাস্টবিনের আবর্জনার মত সুবিধাবাদী মানুষ জন যাদের দুর্গন্ধে অন্য মানুষদের জীবন ছিন্নভিন্ন হয়ে যাচ্ছে। এটি দ্বারা আধুনিক জীবনের আদর্শহীন রূপ তুলে ধরা হয়েছে। সস্তা কাগজ কালি ও তুলিতে আঁকা শব-সওদাগরদের নিষ্ঠুরতা, নৈতিক কলুষতার ও নিপীড়িতের অমানবিক দুর্দশার এই বাস্তব চিত্রগুলো মানুষের হৃদয়ে স্থায়ী ছাপ ফেলে দিয়েছে।
  • স্বাধীনতার পূর্বে তিনি অনেকগুলো ছবি আছে সেগুলো বর্তমানে অনেকটাই সবার জানাশোনার বাইরেই থেকে গেছে। যেমনঃ ‘শম্ভুগঞ্জ’ (কালি কলমের স্কেচ, ১৯৩৩), ‘হাঁস’ (জলরং, ১৯৩৩), ‘ফসল মাড়াই’ (জলরং, ১৯৩৪), ‘বনানী দুমকা’ (জলরং, ১৯৩৪), ‘পল্লিদৃশ্য’ (জলরং, ১৯৩৪), ‘ঘোড়ার মুখ’ (পেনসিল-তেলরং, ১৯৩৪), ‘বাইসন জু স্টাডি’ (জলরং, ১৯৩৫), ‘মজুর’ (পেনসিল-স্কেচ, ১৯৩৫) ইত্যাদি।
  • ১৯৫১ সালে লন্ডনের স্লেড স্কুল অব আর্টে ২ বছরের পড়া শেষে ফেরত আসার পরে জয়নুলের চিত্রে নতুন একটি ধারা দেখতে পাওয়া যায়, যাকে বলা যায় ‘বাঙালি ধারা’। বাঙালি ধারায় জ্যামিতিক আকারে, অনেক সময়ে আধা-বিমূর্ত আদলের উপস্থিতিতে প্রাথমিক রঙের ব্যবহার ও পারসপেক্টিভের উপস্থিতি ছাড়াই গ্রামীণ বিষয়বস্তু তাদের লক্ষণীয় করে তোলে। এইরকম কয়েকটি উল্লেখযোগ্য চিত্রকর্মঃ ‘দুই মহিলা’ (গোয়াশ, ১৯৫৩), ‘পাইন্যার মা’ (গোয়াশ, ১৯৫৩) ও ‘মহিলা’ (জলরং, ১৯৫৩)।
  • ১৯৫৩ সালে জয়নুল আবেদিন লোকসংস্কৃতির সাথে মাতৃত্বও  নিসর্গেকে যুক্ত করে ২টি ছবি অঙ্কন করেন। মা ও শিশু এবং পাইন্যার মা। দুটি ছবিতেই তিনি মায়ের চরিত্র ফুটিয়ে তুলেছেন বাংলার সাধারণ এক মায়ের রূপকে। পাইন্যার মা চিত্রতে তিনি ফুটিয়ে তুলেছেন মায়ের দুটি হাত রাখা আছে চিবুকের নিচে। দুই হাতে দুটি চুরি। পটভূমিতে রয়েছে কালো রেখার টান। এই শিল্পকর্মটিতে একজন চিন্তামগ্ন মায়ের রহস্যময় এক ভাব ফুটে উঠেছে। ১৯৫৩ সালেই তিনি লাল রং ব্যবহার করে জ্যামিতিক ফর্মে মা নামে আরেকটি চিত্র অঙ্কন করেছেন।
  • তাঁর ‘বিদ্রোহী’, ‘মই দেওয়া’, ‘সাঁওতাল দম্পতি’, ‘অপেক্ষা’ প্রভৃতি সুবিখ্যাত সব চিত্রমালায় তিনি আবেগাক্রান্ত অতিশায়ন বা কাব্যিক লালিত্যের থেকে বেরিয়ে দৃশ্যের নৈমিত্তিকতাকে প্রতিভাত করাতে চেয়েছেন। তিনি চিত্রমালায়গুলোতে  দিয়েছেন অভূতপূর্ব গতিময়তা।
  • জয়নুল আবেদিন “জীবন” নামে ১৯৫৪  সালে একটি ছবি আঁকে। যে ছবিতে দেখা যায় যে কাদায় আটকে গিয়েছে একটি গরুর গাড়ি। দুটি গরু এবং একজন মানুষ গরুর গাড়িটিকে তাদের সর্বাত্মক চেষ্টা করে কাদা থেকে তোলার প্রয়াস করছে। চিত্রকর্মটি আঁকা অ্যাগ ট্যাম্পারায়। মানুষ ও পশু শক্তির সমন্বিত ধারণা এই চিত্রের মাধ্যমে তিনি প্রকাশ করেছেন। এর মাধ্যমে তিনি চেয়েছেন মানুষের মনে মহৎ উপলব্ধির সঞ্চার করতে। মানুষের জীবন সংগ্রামে সাধারণত দেখা যায় যে বাংলাদেশের মেহনতী মানুষ পশুর মত পরিশ্রম করে কিন্তু সেই অনুযায়ী তারা মূল্য পায় না। জীবন চিত্রে দেখা যায় যে দুটি গরু সামনে থাকলেও মানুষ তার সম্পূর্ণ পেশি শক্তি ব্যবহার করে গাড়িটিকে কাদা থেকে টেনে তুলছে।
  • ১৯৫৪ সালে জয়নুল আবেদিন জ্যামিতিক ফর্মে “কলসি কাঁখে বধু”  চিত্রকর্মটি একেছেন। তিনি এই চিত্রকর্মটি আঁকার ক্ষেত্রে কিউবিস্ট ধারাকে অনুসরণ করেন। এই ধারা অনুযায়ী শিল্পীরা বস্তুর গঠনের ওপর বেশি গুরুত্ব দেন। সেজন্য তারা বস্তুর গঠনকে দৈর্ঘ্য প্রস্থ উচ্চতায় বিভক্ত করে এবং বস্তুর ঘনত্বকে রেখা এবং রঙের মাধ্যমে বিভক্ত করে দেখেছেন। এই ধারার মূলে রয়েছে পিকাসোর প্রভাব। পিকাসোর মত তিনিও তার ১৯৫৪ সালে আঁকা “গুলটানা” চিত্রে জ্যামিতিক নকশায় বিভক্ত করেছেন। এই সঙ্গে তিনি যুক্ত করেছেন লোকজ জীবনকে। এই চিত্রকর্মে তিনি বোঝাতে চেয়েছেন পেশী শক্তির সাথে লোকজ জীবনের একটি নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে।
  • জয়নুল আবেদিন পটুয়ার ছবি এঁকেছেন যখন তিনি রাজশাহী শহরে কুমারদের হাতের কাজ দেখেছেন। তিনি তার শিল্পকর্মটিতে গ্রামের মহিলাদের রূপচর্চার পরিচিত দৃশ্যকে তুলে ধরেছেন। “প্রসাধন” এই ধারার দুইটি ছবি। এই চিত্র 2 টি অঙ্কনের সময় লোকজ রীতির সঙ্গে কিউবিজমের সংমিশ্রণ ঘটিয়েছেন। তার কিউবিক রীতিতে আঁকা আরেকটি ছবি হলো “বাঙালি কুমারী”। রঙিন কালিতে আঁকা চিত্রকর্মটিতে ব্যবহার করা হয়েছে হালকা লাল ও নীল রং। যেখানে গ্রামীণ সাধারণ বাঙালি কুমারীদের সহজ-সরল অবয়ব ফুটে উঠেছে।
  • আদিবাসীদের জীবন তার ওপর গভীর প্রভাব ফেলেছিল। যা তার চিত্র “বাড়ির পথে সাঁওতাল দম্পতি” (১৯৫১),  “দু’জন সাঁওতাল রমনী” (১৯৫৯)  চিত্রতে দেখা যায়।
  • ১৯৫১ সালে জয়নুল আবেদিন “বিদ্রোহী” ছবি আঁকেন। এই ছবিতে দেখা যায় এক দুগ্ধবতী গাভী তার প্রচন্ড শক্তি প্রয়োগ করে তাকে বাঁধা দড়ি ছিড়ার চেষ্টা করতেছে। এই চিত্রটি দ্বারা তিনি বিদ্রোহী বাঙ্গালীদের অবস্থা তুলে ধরেছেন। এই ছবির পুরো দৃশ্যপট উজ্জল হালকা ছাই  রঙে রঞ্জিত। এটিকে জয়নুল আবেদিনের অন্যতম একটি চিত্রকর্ম হিসেবে ধরা হয়।
  • ১৯৫১ সালে জয়নুল আবেদিনের অঙ্কিত উল্লেখযােগ্য একটি চিত্রকর্ম “খেয়াঘাটে অপেক্ষা”। এটি সম্পূর্ণরূপে জলরঙ দিয়ে এঁকেছেন তিনি। কোন প্রকার খেয়া বা নৌকার বিষয় এই ছবির শিরােনামে অনুপস্থিত। অপেক্ষার বিষয়টি এই চিত্রে অনেকটা সিম্বলিক সারল্যের প্রতীকী হয়ে উপস্থাপিত হয়েছে। এই ছবিটিতে তার সহজাত চিত্ররূপের পরিচয় আমরা সহজেই অনুধাবন করতে পারি।
  • মনপুরা ৭০ শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের আঁকা ছবি ১৯৭০ সালে ১২ নভেম্বর দক্ষিণাঞ্চলে আঘাত হানা ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়ের উপরে। এই ঘূর্ণিঝড়ে প্রায় আট লাখ মানুষ মারা যায়। শত শত গ্রাম প্লাবিত, হাজার হাজার বাড়ি নিশ্চিহ্ন, লক্ষ লক্ষ মানুষ গৃহহারা। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন এই ঘটনায় অনেক কষ্ট পান। নিজের কষ্ট ক্ষোভ তুলির মাধ্যমে প্রকাশ করেন। ১৯৭৪ সালে আঁকা সারি সারি লাশের পাশে স্বজন হারা এক মানুষের বিলাপের ছবি ‘মনপুরা-৭০’।  তিনি এই চিত্রে আধুনিক ভঙ্গিতে লোকজরীতি তুলে ধরেছেন।
  • ১৯৭০ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের নেতৃত্বে ১০-১২ জন তরুণ চিত্রশিল্পী, কবি ও সাংবাদিকের উদ্যোগে শিল্পকলা একাডেমিতে অনুষ্ঠিত হয় নবান্ন চিত্রপ্রদর্শনী। শিল্পাচার্য তাঁর বিখ্যাত দীর্ঘ স্ক্রল “নবান্ন” ছবিটি এই নবান্ন প্রদর্শনী উপলক্ষেই আঁকলেন। এর দৈর্ঘ্য ৬০ ফুট ও প্রস্থ ৬ ফুট। এই স্ক্রলটি শিল্পকলা জগতের মূল্যবান সম্পদ। বাংলাদেশের কৃষকদের ফসল কাটার  আনন্দের সাথে সাথে তাদের জীবনে সকল সুখ দুঃখের কথা তিনি এই স্ক্রলে তুলে ধরেছেন।

জয়নুল আবেদিন ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ঘুরে বেরিয়ে অনেক শিল্পকর্ম দেখেছেন। তিনি তাদের থেকে অনুপ্রেরণা নিয়েছেন কিন্তু কখনো সেগুলোর প্রভাব তার চিত্রকর্মের পড়তে দেন নেই অথবা তাদের অনুকরণ করে নি।

জয়নুল আবেদিনের অর্জনঃ

জয়নুল আবেদিন একজন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন শিল্পী ছিলেন। তার বর্ণাঢ্য জীবনের সম্পূর্ণটাই তিনি দায়ী করেছেন শিল্পের পথে। বাংলাদেশের প্রাতিষ্ঠানিক চিত্রকলা চর্চার রাস্তার তিনি তৈরি করে দিয়েছেন। আমাদের দেশ দেশের ঐতিহ্য দেশের সকল সুখ-দুঃখের কথা বিশ্বদরবারে রং তুলির মাধ্যমে তিনি তুলে ধরেছেন। তাকে বাংলাদেশের কারুশিল্পের কর্ণধারও বলা যায়। বাংলাদেশের চিত্রকরদের মধ্যে তিনি শিল্পগুরু হিসেবে বিবেচিত হয়। এই সৃজনশীল প্রতিভা ধারী ব্যক্তির অর্জন নেহাতই কম নয়। তাঁর অসাধারণ শিল্প-প্রতিভা এবং মহত্‍ মানবিক গুণাবলির জন্যে তিনি সর্বত্র সম্মান পেয়েছেন। দেশে ও বিদেশে বিভিন্ন পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। সরকার এবং গুণমুগ্ধ জনগণের কাছ থেকে পেয়েছেন অনেক সম্মান৷ রাষ্ট্রীয় আমন্ত্রণে তিনি অনেক দেশ ভ্রমণ করেছেন৷ যেমনঃ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, ফ্রান্স, বেলজিয়াম, স্পেন, সুইজারল্যান্ড, পশ্চিম জার্মানি। তিনি যেসব সম্মাননা পানঃ

  • ১৯৩৮ সালে ভারতের ফাইন আর্টস একাডেমি কর্তৃক আয়োজিত সর্ব ভারতীয় চিত্রকলা প্রদর্শনী তে তিনি তারা আঁকানো জলরং এর ছবিটি প্রদর্শন করেন। এই ছবির জন্য তিনি গভর্নরস স্বর্ণপদক লাভ করেন। তাঁর অঙ্কনের মূল বিষয়বস্তু ছিল ব্রহ্মপুত্র নদ।
  • ১৯৫৮ সালে পাকিস্তান সরকার তাকে সম্মানিত প্রাইড অব পারফরম্যান্স শীর্ষক সর্বোচ্চ বেসামরিক খেতাব প্রদান করেন।
  • ১৯৫৯ সালে পাকিস্তান সরকার সংস্কৃত কর্মীদের সর্বোচ্চ সরকারি খেতাব হিলাল-ই-ইমতিয়াজ খেতাব প্রদান করেন। যদিও তিনি এই খেতাবটিকে বর্জন করেন।
  • ১৯৬১ সালে  ইউএসএসআর সরকার দেশের ফাইন আর্টসের চর্চায় অনেক বেশি সাফল্য এবং উন্নতি লক্ষ্য করে এই প্রেক্ষিতে তাকে গোল্ড মেডেল প্রদান করেন।
  • ১৯৬৮ সালে ঢাকা আর্ট কলেজের ছাত্রদের দ্বারা বাংলাদেশে চিত্রশিল্প বিষয়ক শিক্ষার প্রসারে আমৃত্যু প্রচেষ্টার জন্য এবং তার অসাধারণ শিল্প মানসিকতা ও কল্পনা শক্তির জন্য তিনি শিল্পাচার্য উপাধিতে ভূষিত হন। শিল্পাচার্য মানে হল শিল্পের আচার্য অর্থাৎ শিল্পকলায় বিষয়ে একজন নিবেদিতপ্রাণ।  যেই শিক্ষকরা পরিচালকের সহচার্যে একজন ছাত্রের সমস্ত জ্ঞান ধ্যান ধারণা পরিচিতি লাভ করে সেই  শিল্পাচার্য।
  • ১৯৭৪ সালে দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয় তাকে সম্মানসূচক ডি-লিট ডিগ্রি প্রদান করেন।
  • রকফেলার ফাউন্ডেশনের ফেলোশিপ পান।
  • তেহরান আন্তর্জাতিক শিল্পকলা প্রদর্শনীতে তিনি বিচারক হিসেবে মনোনীত হন।
  • ২০০৯ সালের ৯ জুলাই ইন্টারন্যাশনাল অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল ইউনিয়ন (আইএইউ) বুধ গ্রহের একটি জ্বালামুখ তার মানবসভ্যতায় মানবিক মূল্যবোধ ও উপলদ্ধিকে গভীরতর করার প্রেক্ষিতে নামকরণ করা হয় আবেদিন জ্বালামুখ। “আবেদিন জ্বালামুখ” এর দৈর্ঘ্য ১১০ কিলোমিটার এবং উচ্চতা ২২ হাজার ৮০০ কিলোমিটার।
  • ২০১৬ সালে বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর এর ৩৫ সংখ্যক গ্যালারীটিকে শিল্পচার্য জয়নুল আবেদিন চিত্রশালা হিসাবে সজ্জিত করা হয়।
  • ১০৫ তম জন্মদিনে তার গুগল ডুডল ফিচার করে সম্মাননা প্রদান করা হয়।
  • ২০১৯ সাল থেকে ১ জন  নারীসহ সর্বাধিক তিনজন কারুশিল্পীকে প্রতিবছর “শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন আজীবন সম্মাননা পুরস্কার” প্রদান করা হয়। এই সম্মাননার মূল লক্ষ্যই জয়নুল আবেদিন বাংলাদেশের কারুশিল্প নিয়ে যে স্বপ্ন দেখে গিয়েছিলো সেই স্বপ্ন যাতে পূরণ হয়।

শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন সংগ্রহশালাঃ

ছোটবেলা থেকে ব্রহ্মপুত্রের তীরেই জয়নুল আবেদিন মানুষ হয়েছেন। সেই ব্রহ্মপুত্র তীর ধরে বিকালবেলা ঘুরে বেড়ানো ছিল তার নেশার মত। এই জন্য তার চিত্র অঙ্কনের প্রায় একটি বিশাল অংশ জুড়েই ছিল ব্রহ্মপুত্র নদ। এক পর্যায়ে জয়নুল আবেদিন তাঁর নিজের ছবি সংগ্রহের জন্য সংগ্রহশালা নির্মাণ করতে চান এবং যার জন্য তিনি স্থান নির্বাচন করেন ময়মনসিংহে তাঁর অতি প্রিয় ব্রহ্মপুত্র নদের তীরের অবস্থিত কোয়ার্টার নলিনী রঞ্জন সরকারের বাড়ির ভবনকে৷ ময়মনসিংহ জেলা বোর্ডের প্রতি কৃতজ্ঞতাস্বরূপ তিনি তার জন্মস্থান ময়মনসিংহকে উপহার দিয়েছেন একটি আর্ট গ্যালারি। ১৯৭৫ সালে স্থানীয় প্রশাসনের সহযোগিতায় তিনি এটি প্রতিষ্ঠা শুরু করেন।  ১৫ এপ্রিল ১৯৭৫ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে সৈয়দ নজরুল ইসলাম এটি উদ্বোধন করেন। ৭ জুলাই  থেকে সংগ্রহশালাটি আনুষ্ঠানিকভাবে তাদের কার্যক্রম শুরু করে। শুরুতেই এখানে জয়নুল আবেদিনের ৭০টির  মত চিত্রকর্ম ছিল। কিন্তু বর্তমানে আছে ৬৩টির মত। কারণ ১৯৮২ সালে ১৭টি মূল্যবান ছবি চুরি হয়ে যায় যার মধ্যে কেবল ১০টিকেই উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে। এই  চিত্রকর্মের বেশিভাগই তৈলচিত্রঃ বিভিন্ন দেশ ভ্রমনকালে শিল্পাচার্যের অঙ্কিত ছবি, গুণটানা, নদী পারাপারের অপেক্ষায় পিতা-পুত্রের ছবি  এবং দুর্ভিক্ষের ছবি।

প্রথমাবস্থায় ভবনটি একতলা থাকলেও ১৯৮৭ সালে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন সংগ্রহশালাটি ৩.৬৯ একর জমির উপরে একটি দ্বিতল ভবনের রূপ লাভ করে। এই সংগ্রহশালাটি ২০০৬ সালে নতুনভাবে সাজানো হয়। যেখানে নিচতলায় ব্যবস্থাপনা কক্ষসমূহকে রাখা হয় ও দোতলায় স্থাপন করা হয় শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ছবির গ্যালারি। সংগ্রহশালাটির নতুন ডিজাইনে ৪টি শিল্পাচার্যের চিত্রকর্মের গ্যালারি, ২টি শিল্পাচার্যের সংগৃহীত, ব্যবহার্য ও অর্জিত নিদর্শনের গ্যালারি, ১টি শিল্পাচার্যের আলকচিত্রের গ্যালারি, ২টি সমকালীন শিল্পীদের গ্যালারি, ২ টি বিশ্বসভ্যতার গ্যালারি, ২টি ময়মনসিংহের লোকশিল্প নিদর্শনের গ্যালারি, ২টি সাময়িক প্রদর্শনী গ্যালারি এবং ২০০ আসনবিশিষ্ট সেমিনার ও ৫০০ আসনবিশিষ্ট অডিটোরিয়াম রাখা হয়েছে। এই সংগ্রহশালাটি জয়নুল আবেদিন মূলত প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন কারণ বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অনেক দুর্লভ ছবিগুলোকে যাতে তিনি একসাথে সংগ্রহ করতে পারেন। তাই এর মূল উদ্দেশ্য শিল্পাচার্যের অমূল্য নিদর্শনসমূহ ও তার ব্যক্তিগত স্মৃতিকে আরও সুষ্ঠুভাবে সংরক্ষণ করা, পরিচর্যা করা ও নিরাপত্তা প্রদান করা। এছাড়াও  আরেকটি উদ্দেশ্য হলো জয়নুল আবেদিনের শিল্পকর্ম প্রদর্শন ও গবেষণার মাধ্যমে জাতিসত্তার সংস্কৃতি বান্ধব মানসিক বিকাশ ও উদ্দেশ্য সাধন করা। যেহেতু এই সংগ্রহশালাটিতে জয়নুল আবেদিনের সারা জীবনের শিল্পকর্মের বৃহৎ সম্ভার সঞ্চিত আছে সেইজন্য ১৯৯৯ সালে সরকার এই  সংগ্রহশালাটিকে বাংলাদেশের জাতীয় জাদুঘরের একটি শাখা হিসেবে ঘোষণা করে। এরপর থেকে জাতীয় জাদুঘরের অধীনেই এই সংগ্রহশালাটিকে পরিচালনা করা হচ্ছে। এখানে সার্বক্ষণিক সর্বমোট ১৮ জন কর্মকর্তা কাজ করে থাকেন।

শিল্পাচার্য জয়নুল লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশন সোনারগাঁও জাদুঘরঃ

তিনি সবসময় বাংলাদেশের কারুশিল্প লোকশিল্প নিয়ে চিন্তাভাবনা করতেন। ১৯৫৬-৫৭ সালে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন তৎকালীন সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় জাপানের একটি সিরামিক শিল্প নগরী পরিদর্শনে যান। এই সফরের মাধ্যমে তিনি বুঝতে পারেন যদি লোক কারুশিল্পের বিলাপ ঘটে তাহলে আমাদের দেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহ্যবাহী সম্পদ চিরতরে হারিয়ে যাবে। তিনি যখন গ্রাম বাংলার সাধারন লোক কারুশিল্পীদের সাথে দেখা করেন তখন আস্তে আস্তে তিনি বুঝতে পারেন বাংলাদেশের লোকশিল্পের অনেক বেশি সীমাবদ্ধতা রয়েছে। তাই তিনি সবসময় চেষ্টা করেন গ্রামীণ জীবনের সাথে প্রকৃতিও সামঞ্জস্য তা তুলে ধরতে। একসময় তিনি ঠিক করেন লোকশিল্পের নিদর্শনসমূহ পরবর্তী প্রজন্মের জন্য সংগ্রহ সংরক্ষণ করতে হবে। সেই লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে তিনি লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করেন। যার জন্য তিনি বাংলার প্রাচীন রাজধানী ঐতিহাসিক সোনারগাঁও এর পানাম নগরীর একটি পুরনো বাড়িকে বেছে নেন। ১৯৭৫ সালের ১২ মার্চ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সুপরামর্শ এবং পর্যাপ্ত পরিমাণের আর্থিক সাহায্যে এবং শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের আন্তরিক প্রচেষ্টায় প্রতিষ্ঠিত হয় গৌরবদীপ্ত প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশন বা সোনারগাঁও জাদুঘর।

এই  জাদুঘরে তিনি সংরক্ষণ করেন অবহেলিত গ্রাম-বাংলার নিরক্ষর শিল্পীদের হস্তশিল্প, জনজীবনের নিত্য ব্যবহার্য পণ্যসামগ্রী, আদিম জীবনভিত্তিক নির্দেশন। এই জাদুঘরে গ্যালারি সংখ্যা 2 টি। একটি দারুশিল্প গ্যালারি। অপরটি নকশি কাঁথা ও জামদানি গ্যালারি। দারুশিল্প গ্যালারিতে কাঠের তৈরি প্রাচীন ও আধুনিক কালের বিভিন্ন কাঠের খোদাই করা নির্দেশন, প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যের কাঠ, বিভিন্ন কাঠের পণ্য সাজিয়ে রাখা হয়েছে। এছাড়া এতে গ্রামীণ জীবনধারায় যেসব কাঠের ব্যবহার অতীত থেকে হয়ে আসছে তার প্রদর্শনী এবং বর্তমানের বিভিন্ন সামগ্রীর সাথে পুরাতনের মেলবন্ধনের ধারাকে তুলে ধরা হয়েছে। লোক ও কারুশিল্প জাদুঘর এর দ্বিতীয় তলায়ও প্রাকৃতিক ও গ্রামীন পরিবেশের মিলবন্ধন তুলে ধরা হয়েছে। বস্ত্রজাত কারুশিল্পের মূল উপাদান হচ্ছে তুলা। সেই তুলা থেকেই তাঁতিরা বস্ত্র তৈরি করে। এই তলায় প্রদর্শন করানো হয় তুলার ক্ষেত থেকে তুলা সংগ্রহের চিত্র, তুলা থেকে বীজ ছড়ানো, চরকায় সুতো কাটা, জামদানি শাড়ি তৈরি এবং বাজারে বিক্রির দৃশ্য এর চিত্র। এই জাদুঘর বাংলাদেশের  লোক ও কারুশিল্পের প্রসার ঘটানোর জন্য কার্যকরী ভূমিকা রাখছে। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন বাংলাদেশ লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশনের প্রযত্ন পরিষদের প্রথম সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ১৯৭৫ সালের ১লা জুন থেকে ১৯৭৬ সালের ১২ মে পর্যন্ত তার সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। 

শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন পার্কঃ

ময়মনসিংহ শহরের সার্কিট হাউজ সংলগ্ন ব্রহ্মপুত্র নদকে ঘিরে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন মিউজিয়াম এলাকায় প্রাকৃতিক সৌন্দর্য মন্ডিত একটি পার্ক  বাঁধ দিয়ে গড়ে তোলা হয়েছে। এটি শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন পার্ক নামে পরিচিত। সিটি কর্পোরেশন শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন মূল পার্কের প্রায় ১ কিলোমিটার জুড়ে জায়গাকে জয়নুল উদ্যান নামে সংরক্ষিত করেছে। এই পার্কে ঘুরতে গেলে দর্শনাথীরা দেখতে পাবেন দৃষ্টিনন্দন ফোয়ারা, দোলনা, ট্রেন, ম্যাজিক নৌকা, মিনি চিড়িয়াখানা, ঘোড়ার গাড়ি, চরকি। এর সাথে পুরো পার্ক এলাকার একাধিক ঘাটে আছে বাহারি রকমের ব্রহ্মপুত্রের বুকে ভেসে বেড়ানো পাল তোলা নৌকা। এগুলো ভাড়া করে নদীতে ঘুরার সুবিধাও রয়েছে। 

মৃত্যুঃ

শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন ছিলেন চা প্রেমিক এবং ধূমপানে আসক্ত৷ তিনি ফুসফুসের ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে দীর্ঘ ছয় মাস ভুগতে থাকেন।  অবশেষে ১৯৭৬ সালের ২৮ মে মাত্র ৬২ পাশে তিনি শাহবাগের পিজি হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদ প্রাঙ্গণে চারুকলা ইনস্টিটিউট সংলগ্ন চলে তাকে সমাহিত করা হয়। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি তার  চিত্রকর্মকে থামিয়ে রাখেননি।  তিনি মারা যাওয়ার কয়েক দিন আগেও হাসপাতলের বেডে শুয়ে নিজস্ব নিয়মে তার শেষ ছবিটি আঁকেন। দুটো মুখঃ বলিষ্ঠ মোটা রেখায়, কালো কালি আর মোম ব্যবহার করে৷ বাংলাদেশের মানুষের কাছে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন অনুপ্রেরণার নাম। যিনি যুগ যুগ ধরে এদেশের মানুষের মনে স্থায়ীভাবে স্থান করে নিয়েছেন। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন বাংলাদেশের মানুষের হৃদয় জুড়ে প্রতিষ্ঠিত একজন স্বনামধন্য ব্যক্তিত্ব। 

বিঃদ্রঃ এই ব্লগের প্রত্যেকটা ব্লগ পোস্ট Sylhetism ব্লগের নিজস্ব ডিজিটাল সম্পদ। কেউ ব্লগের কোন পোস্ট কিংবা আংশিক অংশ ব্লগের কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া কপি পেস্ট করে অন্য কোথাও প্রকাশ করলে ব্লগ কর্তৃপক্ষ ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনে মামলা করার অধিকার রাখে। এবং অবশ্যই কপিরাইট ক্লাইম করে যে মাধ্যমে এই ব্লগের পোস্ট প্রকাশ করা হবে সেখানেও অভিযোগ সাবমিট করা হবে।

ধন্যবাদ, ব্লগ কর্তৃপক্ষ।

Author

Leave a Comment

Scroll to Top