Last Updated on 6th April 2024 by Mijanur Rahman
রোমান সম্রাজ্যে ফুলকে ধরা হতো ভালোবাসার প্রতীক হিসেবে। হবেই বা না কেনো? ফুলের অমৃত সুগন্ধ মানব শরীরের নাসিকারন্ধে পৌঁছে শিরা উপশিরা পেরিয়ে ভালোবাসার হরমোন অক্সিটোসিন কে উদ্বেলিত করে দেয়। ফলে হৃদয়জুড়ে চলে আসে ম্রিয়মাণ প্রেমের আলোড়ন।
ফুলের দর্শন পেলেই প্রেমিকার শত রাগ,মান-অভিমান সব হাওয়া হয়ে উল্টো তা ভালোবাসায় পরিণত হয়। তবে সেই ফুলটা যদি কাঠগোলাপ হয়,তাহলে তো কথাই নেই। প্রেমিকার অসম্ভব রাগকে মুহুর্তেই সম্ভব করে দেয় কয়েক গুচ্ছ কাঠগোলাপের জাদু।
কাঠগোলাপের উৎপত্তিঃ
কাঠগোলাপের ইংরেজি নাম ‘Plumeria । তবে স্থানীয়রা এটিকে Frangipani নামে চিনেন। ১৭তম শতাব্দীর যাত্রাপথে ফ্রান্সের উদ্ভিদবিদ “Charles Plumier” সর্বপ্রথম এই ফুলটির অস্তিত্ব সবার সামনে তুলে আনেন। তিনিই ফুলটির বিশাল এক সময় ভ্রমন বর্ননা এবং বিভিন্ন জাত বর্ননা করেন। তাই উনার নামানুসারে ফুলটির নাম রাখা হয় ‘Plumeria’। তবে লেখক “Peter loewer” মতে, ইনিই প্রথম ব্যক্তি নন, যিনি এই ফুলটির প্রথম সন্ধান পান। এই ফুলটি সর্বপ্রথম খুঁজে পাওয়ার সম্মাননা যাবে একজন স্প্যানিশ খ্রিস্টান পাদ্রী ” Francisco de Mendoza” এর দিকে, যিনি ফুলটি খুঁজে পান ১৫২২ সালে।
প্রশ্ন হতে পারে, তাহলে স্থানীয়রা এই ফুলটিকে Frangipani নামে কেনো ডাকেন? Plumeria ডাকলেই তো সব ঝামেলা মিটমাট হয়ে যায়। কথিত আছে “Marquis Frangipane ” নামের একজন ইতালিয়ান ঔপন্যাসিক ১৬তম শতাব্দির দিকে ফুলটি দিয়ে এক ধরনের সুগন্ধি তৈরী করেন। যখনি সুগন্ধিটা মানুষের নাকে চলে আসত, তখনি Marquis Franginipane এর নাম মানুষের মাথায় হানা দিত। আর এমনি এমনি করে সেই সুগন্ধিটা সেই সময়ে বিখ্যাত হয়ে এর অমৃত ঘ্রানের কারনে। যার কারনে স্থানীয়রা ফুলটিকে তার সুগন্ধি উৎপাদকের নাম ধরে চিনত। মানুষের মুখে মুখে উচ্চারণের বিবর্তনের কারনে “Marquis Frangipane” নামের শেষের ‘e’ বর্ণটা ‘i’ হয়ে যায়। আর সেখান থেকেই ফুলটির স্থানীয় নাম ‘Frangipani’।
এই ফুলটির বিশেষ কিছু ইঙ্গিতপূর্ন অর্থ বিদ্যমান। যেমনঃ
- কঠিন প্রতিযোগিতায় সবচেয়ে কঠোর শক্তিশালী।
- অলৌকিক ও আধ্মাতিক শক্তির সঙ্গে যুক্ত।
- ভালোবাসা ও রক্তের সম্পর্কে অটুট বন্ধন যা মৃত্যুর আগে ও পরে চিরকাল টিকে থাকবে।
- নতুন অতিথিদের স্বাগত জানানো এবং তাদেরকে মেজবানের বাসায় কিছুদিন থাকবার আহবান।
অনেক দেশে এই ফুলটির অনেক রকমের নাম বিদ্যমান। যেমনঃ মেক্সিকোতে এটিকে “ক্যাকালোক্সচিটোল” নামে ডাকা হয়। শ্রীলংকার সিংহলিতে এটিকে আরালিয়া বলা হয়। এমনভাবে পাকিস্তানে চম্পা, ব্রাজিলে জেসমিন মাঙ্গা, চিনে জি দান গুয়া এবং যুক্তরাষ্ট্র নোসগে নামেই পরিচিত। ১৯৭১ সালে নিকারাগুয়ে দেশটি কাঠগোলাপকে জাতীয় ফুল হিসেবে ঘোষণা করে, যেখানে এটিকে ‘সাকানজোচে’ নামে চিনা হয়। এমনকি সে দেশের কিছু ব্যাংক নোটেও কাঠগোলাপ ফুলকে চিত্রিত করে নোটছাপা হয়।
কাঠগোলাপের বিররণঃ
সারা বিশ্বে কাঠগোলাপ ফুলটি পরিচিত এর অসাধারণ সুঘ্রাণ, বৈচিত্র্যময় আকার আর তুলতুলে মিহি নরম অনুভবের জন্য। দুধের মতন সাদা,হলুদ, গোলাপি সহ ফুলটিতে রয়েছে নানান রঙের বাহার। সাধারণত এই ফুল গাছটির উচ্চতা ৩০ থেকে ৪০ ফুট পর্যন্ত হয়ে থাকে। গুল্ম জাতীয় উদ্ভিদ হওয়ায় গাছের আকার কিছু মাঝারী ধরনের হয়। এর ডালগুলি রসালো এবং ডালের রস কিছুটা বিষাক্ত। গন্ধেও রয়েছে তীব্রতা। নরম, ভঙ্গুর শাখা-প্রশাখা ছড়ানো-ছিটানো, দুধকষভরা। পাতা কিছুটা বড় ও লম্বা। পাঁচটি ছড়ানো পাপড়ির ফুলগুলো পাঁচ থেকে আট ইঞ্চি চওড়া।
পাপড়ির কেন্দ্রে কিছুটা হলদে বা কমলা রঙের ছোঁয়া থাকে। ফুলের পাশাপাশি এর পাতার বিন্যাসের সৌন্দর্যও দৃষ্টি কাড়ে কাঠগোলাপের গাছ ঝোপ আকৃতির, এবং পরিস্থিতিভেদে কয়েক মিটার উঁচু হতে পারে। গাছে পাতা গজানোর আগেই ফুল ফুটতে পারে। এর পাতাগুলো ডালের শেষপ্রান্তে গুচ্ছবদ্ধ হয়ে থাকে, পাতা ঝরার পর ডালে একটি চিহ্ণ রয়ে যায়।
কাঠগোলাপ ফুলের আকৃতি অনেকটা লম্বাটে হয়।রঙের অবস্থাভেদে এই ফুলটিকে ৩ ভাগে করা যায়।
- লাল কাঠ গোলাপ
- গোলাপি কাঠগোলাপ
- সাদা কাঠগোলাপ।
এই ফুলের জাতগুলো অ্যাপোকিনিসি (Apocynaceae) পরিবার এবং Plumeria বর্গ থেকে এসেছে।এর মধ্যে লাল কাঠগোলাপটি অর্থাৎ Plumeria rubra হলো ডগবেইন গোত্রের অন্তর্ভুক্ত। এই গুল্ম উদ্ভিদটা চারদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে এং ৫ থেকে ৬ ফুট পর্যন্ত লম্বা হতে পারে। এছাড়া এর একটি সরু সরস গুঁড়ি ও পাতলা ধূসর ছাল দিয়ে আচ্ছাদিত সতেজ-রুপ ভোঁতা আরও কিছু শাখা থাকে।
এই ফুল গাছটির সহজেই পাতা ঝরে যায়। বিশেষ করে শীতকাল আসলে পাতা ঝরতে ঝরতে ঝরতে পুরো গাছের চেহরাই বদলে যায়। প্রায়শই ফুলগুলি সকালে ও বিকালে খুব সুগন্ধি ছড়ায়। এই সুগন্ধ গোলাপ, এবং দারুচিনির অনুরূপ। ফুলের কেন্দ্রে রঙ, সাধারণ গোলাপী থেকে হলুদের ছায়াযুক্ত সাদা পর্যন্ত হয়ে থাকে।
কাঠগোলাপ চাষাবাদঃ
এই ফুলটা সারাবছর ফুটলেও বসন্তে অনেক বেশি ফুটে।কারন এই সময়টায় মৌমাছিদের আনাগোনা বেশি থাকে।কাঠগোলাপে কোনো মধু না থাকলেও পতঙ্গ এর গন্ধে আকৃষ্ট হয়ে এর পরাগায়ন ঘটায়। সাধারণত সারা বিশ্বে গ্রীষ্পমন্ডলীয় জলবায়ুতে এই ফুলগাছটি ব্যাপক হারে চাষ করা হয়। মাটি অম্লীয়, ক্ষার, কাটামাটি যেমনই হোকনা কেনো, এই ফুল গাছটি অনায়াসেই জম্মাতে পারে। তবে শুষ্ক এবং মাঝারী ঘরনার আদ্রতা আছে এমন মাটিতে খুব ভালো জম্মায়। ভেজা মাটি কিংবা শীতের মৌসুমে ৫০ ডিগ্রির নিচের তাপমাত্রাযুক্ত স্থানে এটি তেমন ভালো জম্মাতে পারেনা। বরঞ্চ গাছটির গায়ে ঠান্ডা হাওয়া লাগলেই ফুল ফোটানো বন্ধ করে দেয় এবং সব পাতা ঝরিয়ে ফেলে।
ফুল ফোটার আগে প্রাথমিকভাবে নলাকার ফুলগুলি ৫ থেকে ৭.৫ সে.মি ব্যাসের হয় এবং এরা খুব কমই বীজ উৎপাদনে অংশ নেয়। প্রতিষ্ঠিত গাছগুলি বেশ লবণ সহনশীল এবং লবণাক্ত বায়ু পর্যন্ত সহ্য করে। নার্সারিগুলিতে সহজলভ্য কাঠগোলাপ, শীতল মাসে গ্রহণ করা শাখাগুলির কর্তন ও এক সপ্তাহ বা তারও বেশি সময় শুকনো রেখে দেওয়ার মাধ্যমে সহজেই জনন করা যায়। পাশাপাশি বাগান এবং রাস্তা- এবং পার্ক রোপণ, মন্দির এবং কবরস্থানে রোপণেও ব্যবহার করা হয়। আবার কলম করেও কাঠগোলাপের বংশবিস্তার করা সম্ভব। সেক্ষেত্রে যেসব ডালের পাতা ঝরার সম্ভাবনা খুব কম বা খুব একটা পাতা ঝরেনি, সেসব ডাল কলম করার জন্য ব্যবহার করতে হবে।
এবার আসি কিভাবে কাঠগোলাপ চাষ করা যায় তা নিয়ে। কাঠগোলাপ চাষের জন্য আপনাকে খুব বেশি পরিশ্রম করতে হবে। শুধুমাত্র কিছু সতর্কতা অবলম্বন করলেই হবে।
- দোআশঁ মাটিতে এই গাছটি খুব জম্মে। তাই প্রথমেই দোআঁশ মাটি আছে এমন জমি নির্বাচন করুন।
- চাষাবাদ করার জন্য কিছু প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র আগেই সংগ্রহে রাখুন। যেমনঃ কাঠগোলাপের বীজ, ছুরি, জৈব সার, ছাটাই কাঁচি এবং পানি ছিটানোর বোতল।
- এবার বীজ রোপন করার পালা। একটা ধারালো ছুরি দিয়ে বীজগুলো সুন্দরভাবে কেটে পুরো একদিন ভিজিয়ে রাখুন। এরপর জমিতে রোপন করুন। তবে অবশ্যই রোপনকার্যটা বসন্তের শেষ কিংবা গ্রীষ্মের শুরুর দিকে করলে ভালো হয়। এই সময়টা কাঠগোলাপ গাছের জন্য সবচেয়ে উত্তম সময়। এসবের সাথে আরেকটা বিষয় মনে রাখবেন -আপনার জমি যদি কিছুটা বালুময় হয় তাহলে বীজগুলি ১ থেকে ২ ইঞ্চি গভীরে এবং ৫ ফুট দূরে দূরে রোপন করবেন।
- গাছগুলি বড় হওয়ার পর নিয়মিত গাছের গোড়ায় পানি দিন। জমির স্যাতস্যাতে ভাব বজায় রাখুন। কয়েকদিন পরপর পরিদর্শন করে দেখুন কোনো আগাছা জম্মেছে কিনা। জম্মালপ তা কেটে ফেলুন।
- সারের মধ্যে অবশ্যই উচ্চ নাইট্রোজেন যুক্ত সার ব্যবহার করবেন নাহ। এতে গাছের ক্ষতি হতে পারে। এই গাছের জন্য জৈব সার ব্যবহার করাই যথেষ্ট।
- গাছ থেকে রোগবালাই এড়ানোর জন্য গাছের পাতার উপর দাগ বসেছে কিনা দেখবেন। দাগ থাকা মানে পোকায় আক্রান্ত হয়েছে। এমন হলে যথাসম্ভব “হর্টিকালচারাল তেল” দিয়ে আক্রান্ত যুক্ত পাতায় স্প্রে করুন। এর ফলে পোকারা গাছের পাতা থেকে দূরে দূরে থাকবে।
- চাষবাস শেষ। এবার শীত আসার আগেই গাছ থেকে নতুন বীজ সংগ্রহ করে সংরক্ষণ করতে পারেন।
ঠান্ডার কারনে এরা ভালো জম্মাতে পারেনা বলে এমন নয় যে শীতপ্রধান অঞ্চলে এর চাষ করা যাবেনা! অবশ্যই যাবে। তবে তার জন্য ভিন্ন কিছু নিয়ম অবলম্বন করতে হবে। প্রথমত, অবশ্যই কাচের নিচে চাষ করতে হবে। ভালো হয় যদি বিশাল বড় কাচের সংরক্ষণাগারে চাষ করা যায়। দ্বিতিয়ত, কাচের ভিতরের তাপমাত্রা ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াস কিংবা ৫০ ডিগ্রি ফারেনহাইটের উপরে রাখতে হবে। তবে গ্রীষ্মের মাসে এটিকে বাইরের ছায়া যুক্ত রৌদ্রোজ্জল কোনো পরিবেশে রাখা যেতে পারে। সবচেয়ে উত্তম চাষ প্রথার জন্য যুক্তরাজ্যে এটিতে “হর্টিকালচার সোসাইটির” গার্ডেন মেরিটের পুরষ্কার পেয়েছে।
কাঠগোলাপের ব্যবহারঃ
এই গাছটির নানান অংশের ঔষধি ব্যবহারের ব্যাপক প্রভাব রয়েছে। নারকেল তেলের সঙ্গে কাঠগোলাপ গাছের আঠালো কষ মিশিয়ে গায়ে মাখালে চর্মরোগ সেরে উঠে। পেটে গোলযোগ দেখা দিলে এর প্রাণরস হজমীকারক ঔষুধ হিসেবে পেটের ফোলাভাব ও পেটে ব্যথার প্রতিকারেও ব্যবহার করা যায়। এছাড়াও এর ফুল শ্বসনতন্ত্রের সমস্যা যেমনঃ হাঁপানির চিকিৎসায়ও ব্যবহার করা যেতে পারে।
যৌনরোগ দেখা দিলে কাঠগোলাপের ছাল বেটে আক্রান্ত স্থানে লাগিয়ে দিলে তা অতি দ্রুত সেরে যায়। ফুলগুলিকে জল বা রসে সিদ্ধ করে সালাদ তৈরি করে ব্যবহার করা যায় অন্ত্রের গতিবিধি, প্রস্রাবের প্রবাহ এবং গ্যাস এবং কফ নিয়ন্ত্রণের জন্য। লাল কাঠগোলাপ প্রজাতির পাতাগুলি ক্ষত সাড়ানোতে এবং শীতল সংমিশ্রণ তৈরিতেও ব্যবহার হয়। এর ফুল ও কাণ্ড জ্বর, রক্ত আমাশয়, হুপিং কাশি ইত্যাদির নিরাময়ের ঐতিহ্যবাহী চীনা ঔষধ তৈরিতেও কাজে লাগে। যক্ষ্মার ব্যাকটেরিয়ার বৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত করতে এটিকে এন্টিবায়োটিক হিসেবে ব্যবহার করা হয় । এছাড়াও উদ্ভিদটিকে ছত্রাকনাশক, ভাইরাস-প্রতিরোধী, বেদনানাশক, খিঁচুনি-রোধক ঔষধ হিসেবেও দেখানো হয়।
সূদূর কম্বোডিয়াতে লাল কাঠগোলাপের ফুলগুলিকে গলার হার এবং দেবদেবীদের সাজসজ্জা তৈরিতে ব্যবহার করা হয়। এমনকি হাওয়াইয়ান দ্বীপপুঞ্জের মলোকাই দ্বীপে এই ফুলটি চাষ করা হয় শুধুমাত্র গলার মালা তৈরী করবার জন্য। প্রশান্ত মহাসাগরের অনেকগুলো দ্বীপে এর ফুলগুলো থেকে সুগন্ধি তেল উৎপাদন করা হয়। এছাড়াও নারকেলের তেলের সাথে এর সুগন্ধি মিশিয়ে অনেকে মানুষই তা মাথায় মাখেন।
তবে এতসব ইতিবাচক কথামালার ভিতর একটি নেতিবাচক কথা হলো ” USDA Forest Service ” লাল কাঠগোলাপকে একটি বিষাক্ত উদ্ভিদ হিসেবে তালিকাভুক্ত করে এবং গাছের কোনো অংশ খাওয়া কিংবা স্পর্শ করা থেকে সতর্ক করে!”
কোথায় পাওয়া যায় কাঠগোলাপ এবং দামঃ
সাধারণত মধ্য আমেরিকা, মেক্সিকো এবং ক্যারিবিয়ান অঞ্চলে এই কাঠগোলাপ গাছের অস্তিত্ব সবচেয়ে বেশি লক্ষ্য করা যায়। এছাড়াও ব্রাজিলে এর সুবিস্তীর্ণ চাষাবাদ হয়। আপনি চাইলে বাংলাদেশের স্থানীয় নার্সারিগুলোতে খুব সহজেই এই ফুলগাছটির সন্ধান পাবেন। আর দাম? খুব বেশিনা। সাদা কাঠগোলাপের বাজার মূল্য ছোট আকারে ৪০০ টাকা, মাঝারি আকারে ৬০০ টাকা, বড় আকারে ১৫০০ টাকা এবং টব আকারে ১০০ টাকা। তবে সময় পরিস্থিতিতে দাম আরো বাড়তে কিংবা কমতে পারে।
আরো পড়ুনঃ দক্ষিন কোরিয়া, সৌন্দর্যের স্বর্গীয় লীলাভূমি
সুগন্ধি তৈরীতে কাঠগোলাপঃ
প্রাকৃতিকভাবে সুগন্ধি তৈরি করবার সবচেয়ে বড় লাভ হলো এতে কোনো অতিরঞ্জিত রাসায়নিক প্রভাবের সম্ভাবনা থাকেনা। আর তাতে শরীরের কোনো ক্ষতি হবার অনুপাতও কমে যায় শুন্যের কোঠায়।তাই আপনি যদি বাড়িতে বসে প্রাকৃতিক নির্যাসে তৈরী সুগন্ধি বানাতে চান তবে কাঠগোলাপ হবে আপনার জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত। কাঠগোলাপ দিয়ে আপনি যদি একটা উত্তম ঘরনার সুগন্ধি বানাতে চান,তবে নিচের নিয়মগুলো অনুসরণ করতে পারেন।
প্রথমেই যা যা লাগবেঃ
- ২ টেবিল চামচ মিষ্টি আলমন্ড , নারিকেল তেল এবং কাঠগোলাপ ফুলের পাপড়ি।
- আড়াই টেবিল চামচ পানি। বোতলে ভরে নিলে ভালো হয়।
- ৩০ ড্রপস প্রয়োজনীয় তেল নিয়ে ড্রপসগুলোকে তিনভাগে ভাগ করুন। প্রথম ৯ ড্রপস “Top Notes ” হিসেবে আলাদা কাগজে লিখে এক সাইডে রাখুন। একইভাবে ১৫ ড্রপসকে ” Middle notes” এবং শেষ ৬ ড্রপসকে “Base notes” নামে হিসেবে চিহ্নিত করে আলাদা করে রাখুন।
- একটা কফি ফিল্টার।
- ছোট একটা পাইপ।
- দুটি পরিষ্কার কালো গ্লাসের বোতল।
- সামান্য কিছু এলকোহল।
এবার যেভাবে বানাবেনঃ
- একটা পরিষ্কার কালো বোতল নিন। এর ভিতর ২ টেবিল চামচ মিষ্টি আলমন্ড , নারিকেল তেল এবং কাঠগোলাপ ফুলের পাপড়ি নিয়ে প্রয়োজনমতন কাঠি দিয়ে নাড়ুন।
- বোতলের ভিতর প্রয়োজনমতন “Base,middle, top notes ” থেকে তেল নিন। প্রয়োজনে সামান্য কিছু এলকোহল মেশান।
- জিনিসটাকে ভালোভাবে মেশান। মিশ্রণটিকে নিরাপদজনক স্থানে রাখুন এবং ৪৮ ঘন্টা পর্যন্ত এক জায়গায় রেখে দিন। যত বেশি অপেক্ষা করবেন,সুগন্ধিটা তত বেশি ভালো হবে।
- অপেক্ষা করবার পালা শেষ হলে এর সাথে বোতলের পানি মেশান।
- এবার এই বোতলের সবটুকু মিশ্রণ একটা কফি তৈরির মেশিনের ভিতর দিন। কফি ফিল্টার থেকে যা বের হবে,তা আরেকটা বোতলে সংরক্ষণ করুন।
- ব্যাস! হয়ে গেলো আপনার সুগন্ধি। এখন যখন মন চায় ব্যবহার করতে পারেন।
নিজের সুগন্ধি নিজে বানালে আপনার প্রচুর লাভ রয়েছে বলা চলে। একেতো আপনার টাকা বাচল, তার উপর ক্ষতিকারক রাসায়নিক কেমিক্যালও এড়ানো গেলো। এছাড়াও ইচ্ছেমতন সুগন্ধির মাত্রা কমানো-বাড়ানো এবং যাদের স্পর্শকাতর ত্বক, তাদের জন্যও কোনো সমস্যা হবেনা। তবে এসব কিছুর সাথে কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ও মাথায় রাখতে হবে। “Base notes” এর ড্রপস গুলো কিছুটা মারাত্মক, তাই এই ভাগের তেল একবারই ব্যবহার করা উচিত যতক্ষণ না সুগন্ধিতে একটা ভারসাম্য বজায় থাকে। বোতলে ভরে সুগন্ধি ব্যবহার করলে স্রে পাইপ ব্যবহার করা উচিত যাতে সহজেই এটিকে ব্যবহার করা যায়।
কাঠগোলাপ নিয়ে কিছু কবিতা কাব্যঃ
কাঠগোলাপের মায়ায় জড়িয়ে কিছু ক্ষুদে কবি-লেখকগণ কিছু কাব্য কবিতা রচনা করেছেন। তাদের প্রতি সম্মান রেখে নামসহ তাদের কাব্যগুলো সংগ্রহ করে সবার সাথে শেয়ার করছি। সেই সাথে লেখাটির স্বার্থে আমি নিজেও কিছু কাব্য লিখেছি কাঠগোলাপ নিয়ে। সেগুলো প্রথমেই উপস্থাপন করছি।
১)
“তুমি বসন্তের কাঠগোলাপ হয়ে এসেছিলে এক গ্রীষ্মের দুপুরে।
আমি শরতের মেঘ হয়ে তোমার চোখে হেমন্তের নির্জনতা দেখেছিলাম।আর তুমি বর্ষার স্নিগ্ধতা মাখিয়ে হারিয়ে গেলে শীতের কুয়াশার দিগন্তে”
“জোস্নাভেজা স্বপ্নে কাঠগোলাপের সুগন্ধের গভীরে কেবল তোমার ছোয়াই অনুভব করি। আহা মায়া!”
“তোমাকে না পাওয়া মধ্যরাতের একাকিত্বের স্বাদ শত কাঠগোলাপের আড়ালে লুকিয়ে রাখলাম। সুযোগ পেলেই লুফে নিও”
“আমার হৃদপিণ্ডের ভেতরে থাকা রক্তে তোমার নামে লিখে দিলাম একগুচ্ছ কাঠগোলাপের মোহনীয় সুবাস। যার সুগন্ধ তোমার সেই এলোকেশে চুলের কথা স্মৃতি রোমন্থন করিয়ে দেয়। সেই স্মৃতির অন্তরালে আমি একদিন মৃত্ব্যের দুয়ারে পৌঁছে যাব নিশ্চিত ।”
(ফেরদৌস ইসলাম)
২)
“পূর্ণিমার চাঁদ চাই না
দু মুঠো রোদ চাই না
এক ঝাঁক জোনাকি চাই না
ঝাঁপসা বৃষ্টিও চাই না
শুধু দুটি কাঠগোলাপ দিও…?
আমার মৃত্যুর পর..!
আমি চাঁদ হয়ে আলো ছড়াবো
তুমি অনূভব করো
কতোটা ভালোবেসেছিলাম
কতোটা ব্যাকুল ছিলাম
ভালোবাসি কথাটা শোনার জন্য
তোমার জন্য রইলো
আমার স্নিগ্ধ, সুন্দর কাঠগোলাপের ভালোবাসা…”
(কাঠগোলাপের ভালোবাসা -মারজাহান মলি)
৩)
“নতুন এক বইয়ের পাতায় পুরাতন এক কাঠগোলাপ।
রঙ বেরঙের স্বপ্ন এখন অগোছালো আলাপ।
আতর ভেজা ঘামে এক অস্পষ্ট নেশা।
নতুনের মাঝে এক পুরাতন আশা ।
নীলিমা চাদর টেনে চোখ বুজে ম্লান।
বিষাদহীন মন আজ স্বপ্ন উড়ান। “
(কোয়েল)
৪)
“অবাধ্য এই শহরের বুকে যদি ভালোবাসা নেমে আসে চুপ করে।
কাঠগোলাপের আঙিনা জুড়ে তোমার নামেরই ঘর।
একটা চিঠি তোমার নামেই লেখা ছিলো কতকাল আগে।
প্রেয়সী এখন একলা ভীষণ,শরীর জুড়ে নাম না জানা জ্বর।”
(রাখী)
৫)
“মৃতপ্রায় প্রহরগুলি ভীষণভাবে সঙ্গীহীন।
কাঠগোলাপের ভালোবাসার অপেক্ষাতে গুনছে দিন।”
(পৌলমী মজুমদার)
কাঠগোলাপ নিয়ে কিছু জানা-অজানা তথ্য
প্রায় সারা বিশ্বে কাঠগোলাপ জনপ্রিয় একটি ফুল। ফুলটিকে ঘিরে মানুষের রয়েছে নানানরকম ভাবনা। সেই ভাবনাগুলোকে বিশ্বাসের আদলে প্রতিস্থাপন করে কাঠগোলাপ ফুল এবং গাছ নিয়ে পৃথিবীতে অনেক বিচিত্র ও মজার কাজও হয়ে থাকে। মানুষের এমন অদ্ভুত সুন্দর কাজগুলিই লেখার এই শেষ পর্যায়ে সেগুলোই তুলে ধরব।
- খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের অনেক হলোয়িন পোশাক সাজসজ্জা তৈরীতে এই ফুলটির ব্যাপক ব্যবহার রয়েছে।
- নানান রঙে রঙিন অতি সুন্দর গুটিপোকা, নাম “Pseudosphinx tetrio” একমাত্র কাঠগোলাপ গাছের পাতা খেয়ে বেঁচে থাকে।
- ১৯৪০ সালে সর্বপ্রথম “”A Stroll on the Plaza Sant'” গানে “কোলে পোর্টার” কাঠগোলাপ ফুলের নাম উচ্চারণ করেন। সেই সময়ে গানটি প্রচুর জনপ্রিয়তা লাভ করে।
- লাউস দেশে কাঠগোলাপ গাছকে জাতীয় গাছ হিসেবে গণ্য করা হয়, যেখানে গাছটিকে “Dok Jampa” নামে ডাকা হয়। ঔ দেশে এই গাছটিকে পবিত্র গাছ মনে করা হয় এবং প্রতিটি বৌদ্ধ মন্দিরের চারপাশে গাছটি রোপন করা হয় শান্তি ও মঙ্গলের উদ্দেশ্যে।
- কাঠগোলাপ গাছ প্রচন্ড উচ্চ তাপমাত্রায়ও বেঁচে থাকতে পারে। গানিতিক হিসেবে ধরলে সর্বোচ্চ ৫০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা পর্যন্ত বাচঁতে পারে। তবে তাপমাত্রা এর বেশি হলে গাছটিতে আগুন ধরে উঠবার সম্ভাবনা বেড়ে যায়।
- ক্যারিবিয়ান সংস্কৃতিতে কাঠগোলাপ গাছের পাতাকে বেটে ব্যবহার করা হয় আলসার কিংবা শরীরের আঘাতের উপর প্রলেপ দেওয়ার জন্য। এতে শরীরের ক্ষত খুব দ্রুত শুকিয়ে যায়।
- কার্নিংহোম এনসাইক্লোপিডিয়ার মতে, কাঠগোলাপের সুগন্ধিকে ভালোবাসা আর জাদুকরী শক্তি হিসেবে ধরা হয়। ভালোবাসাকে আধ্মাতিক শক্তিকে রুপান্তর করতে এই ফুলের এক অসম শক্তি বিদ্যমান।
- কাঠগোলাপ ফুল নিয়ে আধুনিক পলিনেসিয়ান সংস্কৃতিতে একটা মজার ব্যাপার রয়েছে। এই সংস্কৃতিতে কোনো মহিলার মাথায় ফুল দিয়ে সৌন্দর্যবর্ধন করাটা অনেকটা ফেসবুক রিলেশনশিপ স্ট্যাটাস দেওয়ার মতন। কিভাবে তা বলি!এখানে যদি কোনো মহিলা তার ডান কানে কাঠগোলাপ ফুল গুজে রাখে,এর অর্থ হলো মহিলাটি সিঙ্গেল এবং মিঙ্গেল হওয়ার জন্য প্রেমিকপুরুষ খুঁজতেছে। আর যদি মহিলাটি কাঠগোলাপ ফুলটা তার বাম কানে গুজে রাখে, তবে এর অর্থ হলো মহিলাটি ইতিমধ্যেই মিঙ্গেল অর্থাৎ রিলেশনশিপে বিদ্যমান রয়েছে।
- ভারতে কাঠগোলাপ ফুলকে অমরত্বের চিহ্ন হিসেবে ধরা হয়। কারন এই গাছের সব পাতা ও ফুল ঝরে যাবার পরেও গাছটি আবারো নতুন পাতা-ফুল গজাতে পুরোপুরি সক্ষম। ব্যাপারটা অনেকটা কইমাছের প্রাণের মতন। মরতে মরতে গিয়েও আর মরে না,যেন বেঁচে ফিরে আসে। ভারতের অনেক মন্দিরের আশপাশে এই ফুল গাছটি রোপন করা হয় মন্দিরের পরিবেশকে সুগন্ধির ছোয়া দেবার জন্য।
- ভিয়েতনামে কাঠগোলাপকে ব্যবহার করা হয় রোগ থেকে আরোগ্য লাভ করার জন্য। পেটের বদহজম কিংবা উচ্চ রক্তচাপের জন্য এই গাছের সাদা ফুল কার্যকরী ভূমিকা পালন করে। এছাড়াও মদ তৈরীতেও কাঠগোলাপের ব্যবহার রয়েছে।
মানব শরীরের পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের সংখ্যা কিংবা রঙধনুর রঙের প্রকারভেদ কিংবা শ্রেণীবিন্যাস করা গেলেও গন্ধের কোনো শ্রেণী বিভাজন করা যায়না। রাস্তায়,বাড়িতে, হাঁটে কিংবা বাজারে হাঁটাচলা আমরা নানান রকম গন্ধের সাথে আমরা পরিচিত হই। কিন্তু আমরা এর কোনোটিকেই বর্ননা করতে পারিনা।
কিন্তু একমাত্র কাঠগোলাপ ফুলের গন্ধই নাকে আসলে আলাদা করে চিনা যায়। যেন হাজার বছরের চিরচেরা সেই সুগন্ধি, যা এতকাল টিকে থাকার পরও তার গন্ধের তেজ সামান্যতমও ফিকেঁ হয়নি। ঔষুধ হিসেবে, সুগন্ধি তৈরীতে কিংবা বাসা-বাড়ির শোভা বাড়িয়ে চারদিকে সুগন্ধি ছড়িয়ে দিতে ইত্যাদি প্রায় সব কাজেই কাঠগোলাপের আধিপত্য বিদ্যমান। মনে হয় যেন একের ভিতর সবরকম সুবিধা নিয়ে বাংলাদেশের জনপ্রিয় খেলোয়াড় সাকিব উল হাসানের মতন অলরাউন্ডার হয়ে এগিয়ে যাচ্ছে যুগের যুগ।