Last Updated on 7th April 2024 by Mijanur Rahman
আমরা যে টাকা আয় করে থাকি সবকিছু একসাথে ব্যয় করে ফেলি না, অনেকে আছেন এই আয় থেকে কিছু সঞ্চয় করতে চান, আবার কেউ আছেন ঘরে টাকা না রেখে কোথাও বিনিয়োগ করতে। তো এই বিনিয়োগ বিভিন্ন রকমের হতে পারে। কেউ সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করেন আবার কেউ দেখা গেছে প্রাইজবন্ড কিনে রাখেন। কেউ করেন বীমা আবার কেউ শেয়ার মার্কেটে বিনিয়োগ করেন।
এই বিনিয়োগ অনেক রকমেরই হতে পারে, তেমনি এক প্রাকারের বিনিয়োগ হলো Deposit Pension Scheme, যাকে সংক্ষেপে DPS বলে, তো আজকে আমরা জানবো এই ডিপিএস এর নাড়ি ভুঁড়ি সম্পর্কে বিস্তারিত। আমরা এই লেখাতে দেখবো ডিপিএস কি, ডিপিএস করতে কি কি লাগে, ডিপিএস এর সুবিধা ও অসুবিধা এবং ডিপিএস ভাঙ্গার নিয়ম সম্পর্কে।
তাহলে চলুন প্রথমে জেনে নেই ডিপিএস কি।
ডিপিএস কি?
ডিপিএস এর পূর্ণ অর্থ হলো ডিপোজিট পেনশন স্কিম (Deposit Pension Scheme) । এটি একটি আর্থিক সঞ্চয় পরিকল্পনা যা মাসিক ভিত্তিতে হয়ে থাকে। এই অ্যাকাউন্টে একজন গ্রাহক নির্দিষ্ট সময়ের জন্য নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ জমা করে থাকে।
ডিপিএস গ্রাহকদের একটি নির্দিষ্ট পরিমান মেয়াদ এবং মাসিক সুদ/মুনাফার ব্যবস্থা থাকে। খুব সহজ করে যদি ডিপিএসকে ব্যাখ্যা করতে যাই তাহলে মাসিক ভিত্তিতে নির্দিষ্ট পরিমান টাকা জমা রাখাকে ডিপিএস বলে। মাস ভিত্তিক ব্যাপারটি ব্যাংক এর সিস্টেম অনুযায়ী হয়ে থাকে। কোন কোন ব্যাংক ১ মাস ভিত্তিক মুনাফা দিয়ে থাকে আবার কোন ব্যাংক ৩ মাস বা ৬ মাস ভিত্তিকও হয়ে থাকে।
ডিপিএস এর সুবিধা
ডিপিএস এর বেশ কিছু সুবিধা মুলক দিক রয়েছে। নিম্নে এর সুবিধা মুলক দিকগুলো নিয়ে আলোচনা করা হলঃ
- প্রথমত যে কোন ব্যক্তি এই অ্যাকাউন্ট খুলতে পারে।
- এর সবচেয়ে বড় সুবিধা হচ্ছে আপনার যদি ডিপিএস অ্যাকাউন্ট থাকে তাহলে যেই নির্দিষ্ট পরিমান টাকা দিয়ে ডিপিএস করেছেন সেই নির্দিষ্ট পরিমানের একটি অংশ আপনার ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থেকে কেটে নেয়া হবে। অর্থাৎ অটোমেটিক ভাবে ডিপিএসে জমা হবে।
- যদি আপনার একটি স্যালারী বা বেতন এর অ্যাকাউন্ট থাকে তাহলে সেটি বেতন পাওয়ার পর অটোমেটিক এই অ্যাকাউন্টএ জমা হবে
- আপনি আপনার প্রয়োজনে যে কোন সময় ডিপিএস ভেংগে ফেলতে পারবেন
- এর আরেকটি সুবিধা হচ্ছে কোনো মাসে যদি টাকা জমা না দিতে পারেন তাহলে ডিপিএস বন্ধ হবে না।
ডিপিএস এর অসুবিধা
ডিপিএস এর বেশ কিছু সুবিধার পাশাপাশি এর বেশ কিছু অসুবিধাও রয়েছে। নিম্নে এর অসুবিধা মুলক দিকগুলো নিয়ে আলোচনা করা হলঃ
- যদি কোন কারনে এক মাস টাকা জমা না রাখতে পারলে আপনার অ্যাকাউন্ট বন্ধ হবে না ঠিকই কিন্তু পরের মাসে আপনাকে একসাথে দুটি কিস্তি পরিশোধ হবে।
- এই ক্ষেত্রে, যদি আপনি ব্যাংকের নিয়ম অনুযায়ী পরপর তিনটি কিস্তি পরিশোধ করতে ব্যর্থ হন তাহলে সাময়িকভাবে আপনার অ্যাকাউন্ট বন্ধ বা স্থগিত থাকবে।
- আপনাকে পুনরায় পরে ব্যাংকে আসতে হবে এবং কিছু পরিমান টাকা জরিমানার প্রয়োজন হতে পারে।
কোন ব্যাংকগুলি ডিপিএস পরিষেবা দিচ্ছে?
বাংলাদেশের বহু ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠান তাদের গ্রাহকদের এই সেবা প্রদান করে থাকে। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ৫টি ব্যাংক এর নাম নিম্নে দেয়া হল। উল্লেখিত ব্যাংকগুলোর গ্রাহক সুবিধা অনেক বেশি।
১) ইসলামী ব্যাংক।
২) সোনালী ব্যাংক।
৩) ডাচ বাংলা ব্যাংক।
৪) আল আরাফাহ ইসলামী ব্যাংক।
৫) ব্র্যাক ব্যাংক
আরো অনেক ধরনের ব্যাংক রয়েছে যারা ডিপিএস সেবা প্রদান করে থাকে।
কোন ব্যাংক কি পরিমান মুনাফা/সুদ দিয়ে থাকে?
কথায় আছে সঞ্চয় ছাড়া আয়ের কোন দাম নেই। তাই আমাদের জীবনে সঞ্চয় একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আপনি যদি একটু একটু করে সঞ্চয় করতে পারেন তাহলে একটা সময়ে অনেক বড় সঞ্চয় এ পরিনত হবে। ডিপিএসএ সঞ্চয় এর পাশাপাশি আপনি কিছু লাভও পাবেন। এই সকল ধরনের সঞ্চয় আমাদের বিপদে আপদের অনেক কাজে লাগে আগেও বলেছি এর অনেক বড় সুবিধা হচ্ছে আপনি যখন তখন এটি ভেঙে ফেলতে পারবেন। তাই আমাদের সবারই উচিত অল্প অল্প করে সঞ্চয় করা। এর জন্য ডিপিএস সেবা এক অনন্য মাধ্যম হতে পারে আপনার জন্য। অনেক ধরনের ব্যাংক রয়েছে যারা এই সকল সেবা প্রদান করে থাকে। নিম্নে ১৫ টি ব্যাংকের ডিপিএস এর নাম, সময়, কিস্তি, ওয়েবসাইট এবং সুদ/মুনাফা নিয়ে একটি ছক তৈরি করা হয়েছে যাতে আপনাদের বুঝতে সুবিধা হয়।
ব্যাংকের নাম | বছর | মাসিক ভিত্তিক কিস্তি টাকায়। | শতকরা মুনাফা/সুদ | প্রয়োজনীয় তথ্য এর জন্য ব্যাংকের ওয়েবসাইট |
ন্যাশনাল ব্যাংক লিমিটেড | ৩, ৬, ৮ ও ১০ | ৫০০ থেকে ১০০০, ২০০০, ৫০০০ ও ১০০০০ | ৭.৭৫ থেকে ৯.৫ টাকা | |
ঢাকা ব্যাংক লিমিটেড | ৪, ৫, ৬, ৭, ৮, ৯ ও ১০ | ৫০০, ১০০০, ১৫০০ টাকা | ৬, ৭, ৮, ৮.৫, ৮.৭৫, ৯ ও ৯.৫ টাকা | |
সোনালী ব্যাংক লিমিটেড | ৫ বছর | ৫০০, ১০০০, ২০০০, ৩০০০, ৪০০০ থেকে সর্বোচ্চ ১০০০০ টাকা। | ৭.২৫, ৭.৫, ৮ ও ৮.২৫ টাকা | |
ডাচ-বাংলা ব্যাংক লিমিটেড | ৩, ৫, ৮ ও ১০ বছর | ৫০০, ১০০০, ১৫০০, ২০০০, ২৫০০, ৩০০০ থেকে ৫০০০ টাকা | ৭.৫ টাকা | |
আইএফআইসি | ৩ ও ৫ বছর | ৫০০ টাকা | ৮.২৫, ৯, ৯.২৫ ও ৯.৫ টাকা | |
ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক | ৫ ও ১০ বছর | ৫০০, ১০০০, ৫০০০, ১০০০০, ১৫০০০ ও ২৫০০০ টাকা | ৯ টাকা | |
ট্রাস্ট ব্যাংক | ৩, ৫, ৭ ও ১০ বছর | ৫০০-৫০০০ টাকা | ৮ টাকা | |
মার্কেন্টাইল ব্যাংক লিমিটেড | ৫, ৮ ও ১০ বছর | ২৫০, ৫০০, ১০০০, ১৫০০, ২৫০০ ও ৫০০০ টাকা। | ৭, ৯ ও ৯.২৫ টাকা | |
সিটি ব্যাংক | ৩, ৫, ৭ ও ১০ বছর | ৫০০, ১০০০, ২০০০, ৫০০০, ১০০০০ থেকে ২০০০০ টাকা | ৮.৫ টাকা | |
অগ্রণী ব্যাংক লিমিটেড | ৫ ও ১০ বছর | ১০০০ থেকে ১০০০০ টাকা | ৭ ও ৯ টাকা | |
পূবালী ব্যাংক লিমিটেড | ৩ ও ৫ বছর | ৫০০, ১০০০, ১৫০০ ও ২০০০ টাকা | ৮.২৫ থেকে ৯.৫ টাকা | |
জনতা ব্যাংক লিমিটেড | ৪ থেকে ১০ বছর | ২০০ থেকে ৫০০০ টাকা | ৮ টাকা | |
স্ট্যান্ডার্ড চাটার্ড | ৩ বছর | কিস্তি ১০০০ টাকা | ৪.৭৫ টাকা | |
শাহাজালাল ইসলামী ব্যাংক | ৩, ৫, ৮ ও ১০ বছর | ৪৫০, ৬৫০, ১২৫০ ও ২৩৫০ টাকা | ৯.২৫ ও ৯ টাকা | |
ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক | ৫, ৮ ও ১০ বছর | ১০০, ২৫০, ৫০০, ১০০০, ১৫০০, ২০০০, ২৫০০ এবং ৫০০০ টাকা | ৯ থেকে ১০ টাকা |
ডিপিএস করতে কি কি লাগে?
একটি ডিপিএস অ্যাকাউন্ট খোলার জন্য গ্রাহক নিম্নলিখিত ব্যাপারগুলো সহ অ্যাকাউন্টের মনোনীত ব্যক্তির তথ্য এবং তার সম্পর্কে তথ্য প্রদানের জন্য এমএফআই দ্বারা সরবরাহিত একটি ফর্ম পূরণ করতে হবে। এই অ্যাকাউন্ট খোলার জন্য নিম্নলিখিত প্রয়োজনীয় ব্যাপারগুলো আলোচনা করা হলঃ
- আপনাকে অবশ্যই এই দেশের নাগরিক হতে হবে।
- আপনাকে ব্যাংকের নির্ধারিত ফর্ম আবেদন পূরণ করতে হবে।
- যার নামে ডিপিএস হবে তার ছবি লাগবে এবং অন্য একাউন্টেন্ট কর্তৃক সত্যায়িত।
- আপনার ভোটার আইডি কার্ড অথবা পাসপোর্ট অথবা ড্রাইভিং লাইসেন্স এর কপি লাগবে।
- আপনার মনোনীত ব্যক্তির ছবি এবং ভোটার আইডি কার্ড গ্রাহক কর্তৃক সত্যায়িত হতে হবে।
- আপনি যখন অ্যাকাউন্ট খুলবেন সময় গ্রাহক সম্প্রতি ২ টা সত্যায়িত পাসপোর্ট সাইজের ছবি লাগবে।
- যদি কোন ব্যাক্তির বয়স কম হয় অথবা এন আইডি কার্ড, পাসপোর্ট, ড্রাইভিং লাইসেন্স না থাকে তাহলে সেক্ষেত্রে ওই ব্যাক্তির জন্ম সনদের ফটোকপি লাগবে।
মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে কি ডিপিএস ভাংগা যায়?
অনেকেই প্রশ্ন করে থাকেন যে ডিপিএস কি মেয়াদ এর আগেই ভাংগা যায় কিনা। এর উত্তর হচ্ছে জী আপনি মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই ভাংতে পারবেন। আপনার যদি কোন কারনে ডিপিএস ভাংতে হয় তাহলে সে ক্ষেত্রে লাভ কম পাবেন। যদি এমন হয় যে আপনি খুব তাড়াতাড়ি ভেংগে ফেলেছেন তাহলে অনেক সময় সেই লাভ টাও পাওয়া যায় না। শুধু আসল টাকায় উওোলন করতে পারবেন। এর জন্য সব চেয়ে বেশি ভাল আপনি যদি এর মেয়াদ শেষ হওয়ার পর টাকাটা উঠান।
ডিপিএস যদি ভাংগান তাহলে আপনাকে সরকারী নিয়ম অনুসারে লাভের অংশের ১০ শতাংশ থেকে ১৫ শতাংশ কেটে রাখা হবে। এছাড়া ব্যাংক বাবদ কিছু খরচ করতে হবে আপনাকে।
ডিপিএস কি হারাম?
ডিপিএস, ফিক্সড ডিপোজিট, সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ কিংবা প্রাইজবন্ড ক্রয় করার আগে আমাদের প্রথমই চিন্তা আসে এসব হালাল নাকি হারাম। কোন ধরনের বিনিয়োগের ক্ষেত্রে যদি আপনি এমন দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভোগেন, তাহলে এসব ক্ষেত্রে ব্যাংক কিংবা অন্য কোন আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সাথে লেনদেনে না জড়ানোই উত্তম। আরো যেভাবে জানবেন ডিপিএস হালাল নাকি হারামঃ
- ব্যাংককে জিজ্ঞেস করবেন।
- ব্যাংকের কাগজপত্র দেখবেন তারা কিভাবে ডিএপস থেকে আপনাকে লভ্যাংশ প্রদান করে।
- জানামতে কোন ইসলামিক স্কলারের সাথে আপনার পরিচয় থাকলে তাকে জিজ্ঞেস করবেন।
- ইসলামী শরিয়াহ আইন সম্পর্কে যারা ভালো বুঝেন তাদের সাথে এই বিষয়ে আলাপ আলোচনা করলে এ বিষয়ে একটা ভালো ধারনা পাবেন বলেই আমাদের বিশ্বাস।
ডিপিএস ভাঙ্গার নিয়ম
ডিপিএস ভাঙ্গার নিয়ম হচ্ছে মেয়াদ পূর্ণ হলে ডিপিএস ভাঙ্গা, প্রত্যেক ব্যংক কিংবা আর্থিক প্রতিষ্ঠান ডিপিএসের ক্ষেত্রে একই নিয়ম মেনে চলে, বিভিন্ন মেয়াদের ডিপিএস থেকে থাকে। আপনি যত বছরের জন্য ব্যাংকের সাথে চুক্তিতে যাবেন সেই নির্দিষ্ট সময় অতিবাহিত হওয়ার পর চুক্তি অনুযায়ী ব্যাংক আপনাকে লভ্যাংশ দিয়ে থাকবে। দুর্ঘটনাবশত যদি আপনি ডিপিএসের মেয়াদ পুর্ণ হওয়ার আগেই ভেঙ্গে ফেলেন সেক্ষেত্রে লভ্যাংশ অনেক কম পাবেন।
পরিশেষে
সঞ্ছয়ের জন্যে কিংবা বিনিয়োগের জন্যে ডিপিএস এক যুগান্তকারী ধারণা, এর মাধ্যমে যেমন অর্থের সঞ্চয় সম্ভব, আবার সেই সাথে সঞ্চয় থেকে নির্দিষ্ট পরিমাণ মুনাফাও পাওয়া সম্ভব। তাই যাদের ডিপিএস করার ইচ্ছে ও সামর্থ্য আছে তাদের নিকটস্ত ব্যাংকে গিয়ে ডিপিএস করে ফেলা উচিত।
তো বন্ধুরা এই ছিলো আমাদের আজকের লেখা ডিপিএস কি, ডিপিএস করতে কি কি লাগে, ডিপিএস এর সুবিধা ও অসুবিধা এবং ডিপিএস ভাঙ্গার নিয়ম সম্পর্কে এক বিস্তারিত আলোচনা। যদি লেখা সম্পর্কে কোন প্রশ্ন থাকে তাহলে কমেন্ট করে জানাতে ভুলবেন না।
আজকের মতো এখানেই বিদায়, দেখা হবে আগামী লেখাতে।