বেকিং সোডা হল আমাদের রান্নাঘরে থাকা অতিপরিচিত একটি সামগ্রীর নাম। বেকিং সোডাকে খাবার সোডাও বলা হয়ে থাকে। এটি সাধারণত এলাকার ছোট মুদি দোকান থেকে শুরু করে বড় সুপারশপসহ সব জায়গাতেই সুলভ মূল্যে কিনতে পাওয়া যায়। অনেকে মনে করেন বেকিং সোডা শুধুমাত্র কেক, বিস্কুট ইত্যাদি তৈরি করতেই ব্যবহৃত হয়। তবে বাস্তবিকপক্ষে শুধুমাত্র বেকিংয়ের ক্ষেত্রেই নয়, বরং নিত্যদিনের চলার পথের বিভিন্ন কাজ সহজ করে তুলতে এই বেকিং সোডার রয়েছে অসামান্য ভূমিকা। আজকের লেখায় থাকছে বেকিং সোডা কি এবং এটি কি কাজে ব্যবহার করা যায় সেগুলো সম্পর্কিত বিস্তারিত আলোচনা। আশা করি এই লেখাটি শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পড়ার পর সবাই কমবেশি উপকৃত হবেন।
বেকিং সোডা কি?
চলুন লেখার শুরুতেই বেকিং সোডা কি সেটি জেনে নেয়া যাক। তার জন্য আমাদের একটু রসায়নের জগত থেকে ঘুরে আসতে হবে। বেকিং সোডাকে রাসায়নিকভাবে সোডিয়াম বাইকার্বনেট নামে ডাকা হয়। পাশাপাশি এটিকে মাঝেমধ্যে বাইকার্বনেটও (Bicarbonate of Soda) বলা হয়। বেকিং সোডাতে নাহকোলাইট নামক উপাদান বিদ্যমান রয়েছে যে উপাদানটি প্রাকৃতিক খনিজ হিসেবে অত্যন্ত সুপরিচিত। সাধারণত এই বেকিং সোডার সাথে এসিডিক পদার্থ যোগ করা হলে দুটির বিক্রিয়ার মাধ্যমে কার্বন ডাই অক্সাইড নামক গ্যাস তৈরি হয়। এটি খাবারে ব্যবহার করা যায় এমন একটি উপাদান হিসেবে ইউরোপীয় ইউনিয়ন দ্বারা স্বীকৃত। বেকিং সোডার সংকেত হল “NaHCO₃”।

Related : বেকিং পাউডার কি? বেকিং পাউডার কি কাজে ব্যবহার হয়?
বেকিং সোডার ব্যবহারঃ
এতক্ষণে নিশ্চয়ই সবাই বেকিং সোডা কি সেটি বুঝতে পেরেছেন। এবার আসি এটির ব্যবহার নিয়ে। বেকিং সোডার যে ব্যবহারটি কমবেশি সবাই জানেন সেটি হলো বেকিংয়ের ক্ষেত্রে। কেক,পাউরুটি, বিস্কুট ইত্যাদি খাবার তৈরির জন্য বেকিং সোডা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি উপাদান। কারণ এটি খাবার ফোলাতে সহায়তা করে। এটি ছাড়াও বেকিং সোডার আরো নানাবিধ ব্যবহার রয়েছে যেগুলো সবার জেনে রাখা উচিৎ। এ ব্যবহারগুলো হলো-
১। দাঁতের হলদেটে ভাব দূর করতে
ঝকঝকে সাদা দাঁত কার না পছন্দ? কিন্তু বিভিন্ন কারণে আমাদের দাঁত হলদেটে হয়ে যেতে পারে। এ হলুদ দাঁত নিয়ে বাকিদের সামনে বিড়ম্বনায় পড়তে হয়। এ সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে চাইলে চোখ বন্ধ করে বেকিং সোডা ব্যবহার করতে পারেন। দাঁত ব্রাশ করার সময় টুথপেস্টের সাথে বেকিং সোডা মিশিয়ে সপ্তাহে দুইবার ব্যবহারের মাধ্যমে অল্প সময়ের ভেতরেই দাঁতের হলদেটে ভাব কমাতে পারবেন। তবে এক্ষেত্রে অবশ্যই অল্প পরিমাণে বেকিং সোডা ব্যবহার করবেন৷ পাশাপাশি কখনোই প্রতিদিন দাঁতে বেকিং সোডা ব্যবহার করবেননা, কারণ তাতে দাঁতের বাইরের অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
২। শরীর থেকে ঘামের গন্ধ দূর করতে
আমাদের শরীরে ঘাম হওয়া খুব স্বাভাবিক ঘটনা হলেও অনেক সময় এ ঘাম অতিরিক্ত দুর্গন্ধের সৃষ্টি করে, যা অন্যদের কাছে তো বিরক্তিকর বটেই, পাশাপাশি নিজের কাছেও কিন্তু একটি হীনমন্যতার বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। বেকিং সোডা এ দুর্গন্ধ দূর করতে সহায়তা করে।
একটি বাটিতে এক চা চামচ বেকিং সোডা নিয়ে তাতে পরিমাণমতো পানি মিশিয়ে নিন। এমনভাবে পানি মেশান যাতে করে একটি ঘন পেস্ট তৈরি হয়। এ পেস্টটি বগলে লাগিয়ে কিছুক্ষণ হালকাভাবে ম্যাসাজ করুন। তারপর ভালোমতো ধুয়ে ফেলুন। দেখবেন, নিয়মিত এটি ঘামের দুর্গন্ধের সমস্যা ধীরে ধীরে কমে যেতে শুরু করবে।
৩। কনুই ও গোড়ালির কালচে ভাব দূর করতে
অনেকের হাতের কনুই ও পায়ের গোড়ালিতে কালচে ভাব থাকে৷ এ কালচে ভাব দূর করতে বেকিং সোডা ম্যাজিকের মতো কাজ করে। এজন্যে শুরুতেই এক চা চামচ বেকিং সোডার সাথে অল্প একটু পানি বা লেবুর রস মিশিয়ে ঘন একটি পেস্ট তৈরি করে নিন। এই পেস্ট কনুই বা গোড়ালির যে অংশটুকুতে কালচে ভাব রয়েছে সেখানে লাগিয়ে নিন। এরপর একটি পুরনো টুথব্রাশের সাহায্যে দুই থেকে তিন মিনিট কালচে স্থানটি ঘষে নিয়ে কিছুক্ষণ পর ধুয়ে ফেলুন। ভালো ফলাফল পেতে এটি সপ্তাহে অন্তত দুইবার ব্যবহার করুন।
৪। ত্বক থেকে রোদে পোড়া ভাব দূর করতে
প্রতিদিনের বিভিন্ন প্রয়োজনে আমাদের বাড়ির বাইরে যাওয়া অত্যাবশ্যক। বাইরের রোদের অতিরিক্ত তাপের ফলে ত্বকের মধ্যে রোদে পোড়া ভাব দেখা দেয়। এর ফলে ত্বকের স্বাভাবিক উজ্জ্বলতা কমে গিয়ে ত্বক মলিন দেখায়। এটি কমাতে যে বেকিং সোডা কি পরিমাণে উপকারে আসে এটি অনেকেই জানেননা। বেকিং সোডা ব্যবহার করলে সূর্যের তাপে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া ত্বকের পিএইচ লেভেল স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে।
এক্ষেত্রে এক চা চামচ বেকিং সোডার সাথে এমনভাবে পানি মেশান যাতে করে মোটামুটি ঘন একটি পেস্ট তৈরি হয়। ভালোমতো মুখ ধুয়ে নেয়ার পর এই পেস্ট মুখে লাগিয়ে নিন। এরপর শুকিয়ে যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করুন৷ শুকিয়ে গেলে পানি দিয়ে ভালোমতো মুখ ধুয়ে ফেলুন। এটি মুখে প্রতি সপ্তাহে একবার করে ব্যবহার করতে পারেন।
তবে এক্ষেত্রে খেয়াল রাখবেন, যদি আপনার ত্বকের ধরণ সেনসিটিভ হয়, তাহলে এটি ব্যবহার করা যাবেনা। আর সবচেয়ে ভালো হয়, যদি প্রত্যেকেই ত্বকে এটি ব্যবহারের আগে প্যাচ টেস্ট করে নিতে পারেন। কারণ বেকিং সোডার কারণে অনেকের ত্বকে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে৷ তাই আগে থেকেই সতর্ক থেকে প্যাচ টেস্ট করে নেয়া বুদ্ধিমানের কাজ।
৫। রান্নাঘরের পরিষ্কার রাখতে

রান্নাঘরে প্রতিদিন চুলা জ্বালিয়ে রান্না করতে হয় বলে বাড়ির এই ঘরটি খুব সহজেই তেল চিটচিটে হয়ে যায়। অনেকেই অভিযোগ করেন, তারা যতই চেষ্টা করুননা কেন, রান্নাঘরের মেঝের তেল চিটচিটে ভাব কিছুতেই দূর করতে পারেননা। রান্নাঘরের তেল চিটচিটে ভাব দূরতে বেকিং সোডা খুবই ভালো কাজে আসে। প্রথমেই রান্নাঘরের মেঝেতে বেকিং সোডা ছিটিয়ে দিন। এরপর কোনো কাপড়, নেট বা স্পঞ্জ দিয়ে কিছুক্ষণ ঘষে নিন। তারপর পানি দিয়ে পুরো রান্নাঘর মুছে ফেলুন। এটি করলে দেখবেন আপনার রান্নাঘরের মেঝে হয়ে উঠবে নতুনের মতো চকচকে।
রান্নাঘরের মেঝের পাশাপাশি জানালার কোণাতেও কিন্তু তুলনামূলক বেশি ময়লা জমে থাকে৷ এ ময়লা দূর করতে প্রথমে জানালার কোণায় বেকিং সোডা ছিটিয়ে দিন৷ এবার তার ওপরে কিছুটা হোয়াইট ভিনেগার ছিটিয়ে দিন৷ তারপর মিনিট দশেক অপেক্ষা করার পর স্পঞ্জ বা কাপড় দিয়ে জানালার কোণায় ঘষতে শুরু করুন। দেখতে পাবেন, বেকিং সোডা কি অসাধারণভাবে এই জমে থাকা ময়লা তুলে ফেলছে। এভাবে বেকিং সোডার সাহায্যে রান্নাঘর পরিষ্কার রাখতে পারবেন।
৬। যেকোন জিনিসের ওপর থেকে মরিচা দূর করতে
বাতাস ও পানির সংস্পর্শে আসলে অনেক সময় আমাদের প্রয়োজনীয় বিভিন্ন জিনিসের ওপর মরিচা পড়ে যায়। মরিচা পড়ার সবচেয়ে বড় অসুবিধা হলো,একবার এটি পড়লে সে জিনিস আর কোনো কাজে ব্যবহার করা যায়না। যেকোনো ধাতব জিনিসের ওপর থেকে মরিচা দূর করতে বেকিং সোডা অত্যন্ত কার্যকরী। একটি বাটিতে এক কাপ বেকিং সোডা নিয়ে তার সাথে এক কাপ ভিনেগার যোগ করুন৷ এই মিশ্রণ দিয়ে ঘষলে খুব সহজে এবং অল্প পরিশ্রমে মরিচা দূর করতে পারবেন।
৭। ফ্রিজের দুর্গন্ধ দূর করতে
অনেক মানুষ অভিযোগ করেন, ফ্রিজ খুললেই কেমন যেন দুর্গন্ধ নাকে আসে। আসলে ফ্রিজে শাকসবজি, মাছ মাংস, ফলমূল ইত্যাদি রাখা হয় বলে এটি নিয়মিত পরিষ্কার করার সুযোগ হয়ে ওঠেনা। একারণে ফ্রিজে দুর্গন্ধ হতে পারে। এটি দূর করতে ব্যবহার করতে পারেন বেকিং সোডা। এজন্যে একটি ছোট কৌটা নিয়ে তাতে ফুটো করে নিন। এবার কৌটাটিতে আধা কাপের মতো বেকিং সোডা নিন৷ এটির সাথে নিজের পছন্দমতো যেকোনো এসেনশিয়াল ওয়েলের পাঁচ থেকে ছয় ফোঁটা যোগ করুন। এক্ষেত্রে আমি সাজেশন হিসেবে বলবো লেমন কিংবা অরেঞ্জ এসেনশিয়াল ওয়েল ব্যবহার করতে। এ কৌটাটি ফ্রিজের যেকোনো কোণায়
রেখে দিলেই ফ্রিজের দুর্গন্ধ চলে যাবে এবং প্রতিবার ফ্রিজ খোলার পর ফ্রেশ ফ্রেশ একধরণের সুগন্ধ পাবেন।
৮। ফল ও শাকসবজি জীবাণুমুক্ত করতে
খাদ্যে ভেজাল কিংবা ফর্মালিন নিয়ে আমাদের চিন্তার যেন কোন শেষ নেই। বাজার থেকে প্রতিবার ফলমূল, শাকসবজি কেনার সময়েই আমরা ভয়ে থাকি যে এগুলো তাজা রাখতে কোন ক্ষতিকর কেমিক্যাল ব্যবহার করা হয়েছে কিনা, কিংবা এগুলো আসলেই খাওয়ার উপযোগী কিনা। বেকিং সোডা সবার এই ভয় দূর করতে উপকারে আসে, কেননা বেকিং সোডা খুব ভালো জীবাণুনাশক হিসেবে কাজ করে। এজন্যে একটি গামলায় এক চা চামচ বেকিং সোডার সাথে পরিমাণমতো হালকা গরম পানি মিশিয়ে নিন। প্রতিবার বাজার থেকে ফলমূল, শাকসবজি কেনার পর সেগুলো বাড়িতে এনে এই মিশ্রণে ডুবিয়ে রেখে তারপর ঠান্ডা পানি দিয়ে ভালোমতো ধুয়ে ফেলুন৷ এতে করে যাবতীয় ময়লা এবং জীবাণু চলে যাবে৷

৯। আসবাবপত্রের মলিন ভাব দূর করতে
ঘরের আসবাবপত্রগুলো আমাদের একটু বেশি ই প্রিয়। কারণ এগুলোর সাথে জড়িয়ে থাকে আমাদের আবেগ এবং অনেক স্মৃতি। তাই যখন কিছু বছর ব্যবহারের পর এই আসবাবপত্রের চেহারা মলিন হতে শুরু করে, তখন মন খারাপ হওয়া খুব স্বাভাবিক। তবে আর মন খারাপ করে থাকতে হবেনা। কারণ আসবাবপত্রের মলিন ভাব দূর করে সেগুলোকে চকচকে করে তুলতে বেকিং সোডা খুব ভালো কাজে আসে। আসবাবপত্র যে ভেজা স্পঞ্জ দিয়ে পরিষ্কার করবেন, সেটিতে একটু বেকিং সোডা ছিটিয়ে দিন৷ তারপর ঘরের আসবাবপত্র পরিষ্কার করুন৷ দেখবেন, সেগুলো নতুনের মতো চকচক করছে।
১০। ঘরের কার্পেট পরিষ্কার করতে
ঘরের সৌন্দর্য্য বাড়াতে কার্পেট তো কমবেশি সবাই ব্যবহার করেন। তবে অনেকে মনে করেন, কার্পেট ময়লা হয়ে গেলে সেটি পরিষ্কার করতে বুঝি দামি কোন ক্লিনজার ব্যবহার করতে হয়। দামি ক্লিনজার নয়, চাইলে বেকিং সোডা দিয়েই কার্পেট পরিষ্কার করতে পারবেন। এজন্যে কার্পেটের ওপর বেকিং সোডা ছিটিয়ে দিয়ে পনেরো থেকে বিশ মিনিট অপেক্ষার পর ভ্যাকুয়াম ক্লিনারের সাহায্যে পরিষ্কার করে নিন।
এটুকুই ছিলো আজকের আলোচনা। আশা করি বেকিং সোডা কি এবং এটি কি কি কাজে ব্যবহার করা যায় সেটি সবাই বুঝতে পেরেছেন৷ বেকিং সোডা দামে সস্তা বলে খুব কম খরচেই এটি কিনে নিতে পারবেন। তাই এটির সাহায্যে বেকিং ছাড়াও অন্যান্য সমস্যাগুলোর সমাধান করতে ভুলবেননা৷
Related : বেকিং পাউডার কি? বেকিং পাউডার কি কাজে ব্যবহার হয়?
বিঃদ্রঃ এই ব্লগের প্রত্যেকটা ব্লগ পোস্ট Sylhetism ব্লগের নিজস্ব ডিজিটাল সম্পদ। কেউ ব্লগের কোন পোস্ট কিংবা আংশিক অংশ ব্লগের কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া কপি পেস্ট করে অন্য কোথাও প্রকাশ করলে ব্লগ কর্তৃপক্ষ ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনে মামলা করার অধিকার রাখে। এবং অবশ্যই কপিরাইট ক্লাইম করে যে মাধ্যমে এই ব্লগের পোস্ট প্রকাশ করা হবে সেখানেও অভিযোগ সাবমিট করা হবে।
ধন্যবাদ, ব্লগ কর্তৃপক্ষ।